মিয়ানমারের ৯৫ সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশে, নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে মানুষ

Post Thumbnail

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে চলছে তুমুল লড়াই। জান্তা সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির রক্তক্ষয়ী এ সংঘর্ষে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সীমান্ত এলাকায়। মর্টার শেল ও বিরামহীন গোলাগুলির শব্দে ঘুম নেই সীমান্তের কয়েক হাজার বাসিন্দার। তুমব্রু কোনারপাড়া, ভাজাবনিয়া ও বাইশফাঁড়ি সীমান্তে শত শত পরিবার যে যেভাবে পারছে, নিরাপদে আশ্রয়ে ছুটছে।

দোকানপাট ও ঘরবাড়ি বন্ধ করে অন্তত চার হাজার মানুষ অন্যত্র চলে গেছে। বন্ধ রাখা হয়েছে পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদরাসা। সীমান্তজুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক। আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষের পর দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৬৮ সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ।

মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছে বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ৩৭ সদস্য।

সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

বিজিবির সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, এ নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বিজিপি সদস্যের সংখ্যা ৯৫ জনে দাঁড়িয়েছে।

বিজিবি নাসাকা সদস্যদের নিরস্ত্র করে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এর আগে রোববার ৫৮ জন বিজিপি সদস্য সীমান্তে আশ্রয় নেয় বলে জানান বিজিবির এই কর্মকর্তা।

বিজিবির সূত্র জানায়, তাদের অস্ত্র ও গুলি রয়েছে বিজিবির হেফাজতে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া গুলিবিদ্ধ ১৫ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের জান্তা সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে দুইজনকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রোববার রাত ৮টার দিকে বিজিবি সদস্যরা অ্যাম্বুলেন্সে তাদের কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে। তারা হলো জা নি মং ও নিম লাইন কিং। এছাড়াও বেশ কয়েকজনকে কুতুপালংয়ের এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে তিন বাংলাদেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। মর্টার শেল ও গুলি থেমে নেই। কয়েক হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। কিছু লোক এপারে ঢুকে বিজিবি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। উৎকণ্ঠায় রয়েছে সীমান্তের লোকজন।

তুমব্রু সীমান্তের মসজিদের ইমাম খোরশেদ আলম কাওয়াসারী বলেন, গত শনিবার ভোর থেকে ব্যাপক মর্টার শেল ও গুলি চলছে। কয়েক ধাপে মিয়ানমার থেকে বেশকিছু মানুষ বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। তাদের পরনে ছিল বিজিপির পোশাক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিবির এক সদস্য বলেন, শনিবার বিকেল থেকে মিয়ানমারের ভেতরে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে এ সময় বিজিবি কঠোর অবস্থান নেয়। এ অবস্থায় রোববার ভোরে বাংলাদেশে ঢোকে বিজিপির কিছু সশস্ত্র সদস্য।

বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন বলেন, তুমব্রু সীমান্তে ব্যাপক মর্টার শেল ও গোলাগুলি চলছে। আমরা শুনেছি, বেশ কয়েকজন বিজিপি সদস্য এপারে বিজিবির কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তবে কতজন, সেটা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। আমরা জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে সীমান্তে ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বলেছি। সব সংস্থা মিলে আমরা সীমান্ত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি।

তুমব্রু সীমান্তে বিজিবির কাছাকাছি পশ্চিম গুনাপাড়ার বাসিন্দা প্রবীণ ধর জানান, হঠাৎ মিয়ানমারের ছোড়া গুলিতে তিনি আহত হন। দুপুরে পশ্চিম পাহাড়পাড়ার মো. শামসু ও কোনাপাড়ার দিল মোহাম্মদের স্ত্রী আহত হয়েছেন।

গুলিবিদ্ধ প্রবীণ ধরের জামাতা সুরিৎ কুমার বলেন, সকালে মিয়ানমারের ছোড়া গুলিতে আমার শ্বশুর গুলিবিদ্ধ হন। মনে হচ্ছে, যুদ্ধের মধ্যে আছি। আমরাও পরিবার নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি।

ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, রোববার সীমান্তের ওপারে ব্যাপক গুলিবর্ষণের পাশাপাশি হেলিকপ্টার থেকে ফায়ার হচ্ছে। ভয়ে গ্রাম ছাড়ছে মানুষ।

এদিকে, ঘুমধুম ইউনিয়নের মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে যুদ্ধাবস্থার কারণে বাজারপাড়া, হিন্দুপাড়া, কোনাপাড়া, মধ্যমপাড়া ও পশ্চিমকুল এলাকার কয়েক হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়েছে।

তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দা মো. শাহাজান মিয়া বলেন, সীমান্তে রাতদিন আতঙ্কে দিন কাটছে। অনেকে আবার ঘর থেকে বের হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি জীবনে দেখিনি।

নির্মল ধর বলেন, আমরা পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছি। এখানে গোলাগুলির কারণে টেকা যাচ্ছে না। প্রতিদিন গোলাগুলি হচ্ছে। এপারে অনেকের ঘরে গুলি পড়ছে।

ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টু বলেন, রোববার রাত ৩টার পর থেকে ওপারে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি চলছে। ভয়ে গ্রামের লোকজন পাশের এলাকায় চলে যাচ্ছে। আমার বাড়ির আঙিনায়ও একটি মর্টার শেল পড়েছে।

৩৪ বিজিবি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল্লাহ আল মাশরাফি বলেন, বেশ কয়েকজন মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশ সীমানায় সশস্ত্র অবস্থায় চলে আসে। তাদেরকে কর্ডন করে এনে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে। পালিয়ে আসা মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীরা অস্ত্র ও গুলি বিজিবির কাছে জমা রেখেছে।

নাইক্ষ্যংছড়ির স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির তীব্র লড়াই চলছে। মিয়ানমার সীমান্তের ওপার থেকে গুলির তীব্র শব্দ নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে ভেসে আসে। নাইক্ষ্যংছড়ি ও টেকনাফ সীমান্তের ওপারে বিজিপির সিংহভাগ চৌকি আরাকান আর্মির দখলে চলে গেছে। কয়েকটি চৌকি দখলে নেয়ার জন্য উভয়ের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে। মিয়ানমার সীমান্তের ওপার থেকে আসা একটি গোলা বাইশফাঁড়ি এলাকার নুরুল কবীরের বাড়িতে এসে পড়ে। এতে মুহূর্তেই তার বাড়িতে আগুন ধরে যায়। গোলার আঘাত ও আগুনে বাড়ির কেউ হতাহত হননি। ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা এসে আগুন নিভিয়ে ফেলেন। চাষাবাদসহ অন্য কাজ করতে না পারায় স্থানীয় কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়েছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ত্রিরতন চাকমা জানান, মিয়ানমার সীমান্তে দুই বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় কয়েকটি বিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছে।

আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, চলমান ইস্যুতে বিজিবি কাজ করছে। আমরাও বিজিবির সঙ্গে কাজ করছি।

প্রসঙ্গত, এর আগে ২৯ জানুয়ারি মিয়ানমারের সংঘাতের কারণে একদিন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল।