বিকাশ ও নগদ প্রতারক চক্রের ৯ সদস্য গ্রেফতার

Post Thumbnail

মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ, নগদ) প্রতারণার মাধ্যমে শিক্ষাবৃত্তি, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা প্রদানের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎকারী প্রতারক চক্রের নয় সদস্যকে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকা হতে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। সহকারী পুলিশ সুপার ও র‌্যাব-১০ এর গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচোলক এম. জে. সোহেল গণমাধ্যমকে এ খবর নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে র‌্যাব বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারে যে, কতিপয় প্রতারক চক্র বেশ কিছুদিন যাবৎ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান ও মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ/নগদ) ব্যবসায় অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে বিকাশ/নগদের মাধ্যমে মানুষকে প্রতারিত করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-১০ উক্ত প্রতারক চক্রকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি ও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। তদন্তের এক পর্যায়ে র‌্যাব-১০ এর একটি দল জানতে পারে উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার নামে একটি প্রতারক চক্রর কক্সবাজার জেলার পেকুয়া থানায় বসবাসকারী ভিকটিম ইসতাহাদ উদ্দিন সোহান (১৯), পিতা-মোঃ বাবুলের মোবাইল নাম্বারে গত ২২ মার্চ ৩:৩৬টার সময় কল দিয়ে তার নাম্বারে উপবৃত্তির টাকা পাঠাবে বলে কৌশলে তার বিকাশের পিন নাম্বার নিয়ে নেয়। পরবর্তীতে উক্ত প্রতারক চক্র সর্বমোট ৩৮,২৫৮/- (আটত্রিশ হাজার দুইশত আটান্ন) টাকা তার একাউন্ট থেকে সরিয়ে ফেলে। এ ঘটনায় তিনি কক্সবাজার জেলার পেকুয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।

এছাড়া গত ২৪ মার্চ কক্সবাজার জেলার পেকুয়া থানায় জান্নাতুল ফেরদৌস নামে এক শিক্ষাথীর কাছ থেকে একই প্রতারক চক্র ২০,৪০০/- (বিশ হাজার চারশত) টাকা ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানা এলাকার লোকমান হোসেন (৪৪)-এর কাছ থেকে তার ছেলের নামে উপবৃত্তির কথা বলে ১৬৩০০/- (ষোল হাজার তিনশত) টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয়।

তদন্তের ধারাবাহিকতায় গত ২ এপ্রিল রাতে র‌্যাব-১০ এর একটি দল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ও তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানাধীন এলাকায় একটি অভিযান পরিচালনা করে। উক্ত অভিযানে সাধারণ মানুষকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদানের নামে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে প্রতারিত করে বিপুল অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রের অন্যতম মূল হোতা ১। ইসমাইল মাতুব্বর (২১), পিতা-দেলোয়ার মাতুব্বর, সাং-জুমুরকান্দা, থানা-ভাংগা, জেলা-ফরিদপুরসহ চারজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত অপর আসামিদের নাম ২। ইব্রাহীম মাতুব্বর (২৭), পিতা-দেলোয়ার মাতুব্বর, সাং-ঝুমুরকান্দা, ৩। মোঃ মানিক ওরফে মতিউর রহমান (১৯), পিতা-মোখলেছ বেপারী, সাং-পুলিয়া ও ৪। মোঃ সিনবাদ হোসেন (২৪), পিতা-মোঃ আশরাফ আলী মাতব্বর, সাং-কাউলীবেড়া, সর্বথানা-ভাংগা, জেলা-ফরিদপুর বলে জানা যায়।

এ সময় তাদের নিকট হতে ২২টি মোবাইল ফোন, ৩৫টি সিম কার্ড, ০৫টি মোবাইলের চার্জার, ০১টি ল্যাপটপ, ০১টি ব্যাগ ও নগদ-৩০,০০০/- (ত্রিশ হাজার) টাকা উদ্ধার করা হয়।

তদন্তে র‌্যাব-১০ আরও জানতে পারে অন্য আরেকটি প্রতারক চক্র গত ১৩ ফেব্রুয়ারি তারিখ আব্দুল মমিন (৪২) নামক একজন নতুন বিকাশ এজেন্টের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে ৪২,৭৭৭/- (বিয়াল্লিশ হাজার সাতশত সাতাত্তুর) টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর ভিকটিম মমিন উক্ত প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে ডিএমপি ঢাকার ডেমরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।

জিডির সূত্র ধরে একই তারিখ রাতে র‌্যাব-১০ এর দু’টি আভিযানিক দল ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা এলাকায় অপর দু’টি অভিযান পরিচালনা করে মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ/নগদ) ব্যবসায় অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে এজেন্টদের নিকট হতে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে প্রতারিত করে বিপুল অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রের অন্যতম মূল হোতা ১। মোঃ সুমন ইসলাম (২০), পিতা-সবেদ মাতব্বর, সাং-রায়নগর, থানা-ভাঙ্গা, জেলা-ফরিদপুরসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত অপর আসামিরদের নাম ২। মাহমুদুল হাসান পলক (২০), পিতা-ফজলু খান, ৩। সাব্বির খন্দকার (১৯), পিতা-আলমগীর খন্দকার, উভয়সাং-সিরেআইল, থানা-শিবচর, জেলা-মাদারীপুর, ৪। মোঃ সাকিব (১৯), পিতা-মোঃ সফিক, সাং-কালামিদ্যা বাজার ও ৫। রাসেল তালুকদার (২৩), পিতা-ফজেল তালুকদার, সাং-খাকান্দা, উভয়থানা-ভাঙ্গা, জেলা-ফরিদপুর বলে জানা যায়। এ সময় তাদের নিকট হতে ১৪টি মোবাইল ফোন, ৯১টি সিম কার্ড, ০১টি ব্যাগ, ১০৪টি ইয়াবা ট্যাবলে ও নগদ-৫২,৫০০/- (বায়ান্ন হাজার পাঁচশত) টাকা উদ্ধার করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতারকৃত ইসমাইল মাতুব্বর সাধারণ মানুষকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদানের নামে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে প্রতারিত করে অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রটির মূল হোতা। তার নেতৃত্বে পরষ্পর যোগসাজসে চক্রটি প্রায় দুই বছর যাবৎ সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিল। নিরিবিলি স্থান হিসেবে তারা দক্ষিণ কেরাণীগনঞ্জ এলাকায় বেছে নেয় যাতে নির্বিঘ্নে প্রতারণার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। তারা প্রথমে উপবৃত্তির ওয়েবসাইট থেকে উপবৃত্তির তালিকা সংগ্রহ করতো। পরবর্তীতে ইসমাইল প্রথমে বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে ক্লোন করে বিকাশ/নগদ একাউন্ট খোলা ভিকটিমদের বিভিন্ন মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে নিজেকে শিক্ষা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদানের কথা বলে প্রলুব্ধ করে। অতঃপর বিশেষ মোবাইল অ্যাপসের সহায়তায় ভিকটিমদের মোবাইলে ফোন করে সিরিয়াল নম্বরের কথা বলে অথবা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে বিকাশ/নগদের ওটিপি সংগ্রহ করত। উক্ত ওটিপির মাধ্যমে তারা ভিকটিমদের বিকাশ/নগদ একাউন্ট হ্যাক করে অন্য একাউন্টে স্থানান্তর করার মাধ্যমে ভিকটিমদের টাকা আত্মসাৎ করত। একইভাবে তারা একাধিক ভিকটিমের বিকাশ/নগদ একাউন্টের পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে রাখতো এবং একটি মোবাইলে একাধিক বিকাশ/নগদ অ্যাপস ডাউনলোড করে একাউন্টে লগইন করে রাখতো। অতঃপর উক্ত একাউন্টে কোন টাকা প্রবেশ করা মাত্র ইসমাইল মোবাইলে নটিফিকেশনের মাধ্যমে তা জানতে পারে এবং সাথে সাথে উক্ত টাকা তার অন্যান্য সহযোগী ইব্রাহীম, মানিক ও সিনবাদের একাউন্টে স্থানান্তর করে। পরবর্তীতে সিনবাদ উক্ত টাকা তাদের আশপাশের অথবা দূরবর্তী বিভিন্ন এলাকা হতে ক্যাশআউট করে ইসমাইলের কাছে নিয়ে আসতো। অতঃপর উক্ত টাকা তারা সবাই মিলে ভাগ করে নিত। চক্রটি এ যাবৎ এক বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে শতাধিক সাধারণ মানুষের নিকট হতে বয়স্ক ভাতা, বিধাব ভাতা ও উপবৃত্তি প্রদানের প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় ২০-২৫ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে জানায়। চক্রটির সবাই স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার আশায় এই প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা যায়।

জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরো জানা, গ্রেফতারকৃত মোঃ সুমন ইসলাম মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ/নগদ) ব্যবসায় অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে এজেন্টদের নিকট হতে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে প্রতারিত করে অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রটির মূল হোতা। তার নেতৃত্বে পরষ্পর যোগসাজশে চক্রটি প্রায় ৮-৯ মাস যাবৎ বিভিন্ন বিকাশ/নগদ ব্যবসায়ী এজেন্টদের সাথে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিল। তারা সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা হতে অবৈধ উপায়ে নতুন এজেন্টদের নাম্বার সংগ্রহ করতো। সুমন প্রথমে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে বিকাশ/নগদের প্রতিনিধিদের নম্বর ক্লোন করে বিভিন্ন বিকাশ/নগদ এজেন্টদের ফোন দিয়ে নিজেকে বিকাশ/নগদের প্রতিনিধির পরিচয় দিত। তারা প্রতিদিন গড়ে ২০টা নাম্বারে কল দিতো। অতঃপর বিকাশ/নগদ এজেন্টদেরকে হাজারে ৪ টাকার পরিবর্তে ৮-১০ টাকা লাভ করার বিভিন্ন অফার সম্পর্কে অবহিত করতো। এক্ষেত্রে এজেন্টরা উক্ত অফার সম্পর্কে অবগত নয় বললে সুমন এজেন্টদের নিকট হতে বিকাশ/নগদের এসআরের ফোন নম্বর নিয়ে ক্লোন করে উক্ত নম্বর হতে এজেন্টদের ফোন করে সার্ভিস রিপ্রেজেনটেটিভের (এসআর) পরিচয় দিয়ে বলতো উনি আমাদের বস উনি যা বলেন সেভাবে কাজ করেন বলে ফোন কেটে দিত। তারপর সুমন মোবাইলে ওটিপি প্রেরণের মাধ্যমে কৌশলে এজেন্টদের নিকট হতে বিকাশ/নগদের এজেন্ট নম্বরের পাসওয়ার্ডটি সংগ্রহ করতো। একইভাবে একাধিক ভিকটিমদের পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে একটি মোবাইলে একাধিক বিকাশ/নগদ অ্যাপস ডাউনলোড করে এবং প্রত্যেকটি একাউন্টে লগইন করে রাখতো। অতঃপর উক্ত একাউন্টে কোন টাকা প্রবেশ করা মাত্র সুমন মোবাইলে নোটিফিকেশনের মাধ্যমে তা জানতে পারে এবং সাথে সাথে উক্ত টাকা তার অন্যান্য সহযোগী মাহমুদুল, সাব্বির, সাকিব ও রাসেলের একাউন্টে স্থানান্তর করে। পরবর্তীতে রাসেল উক্ত টাকা তাদের আশপাশের বিভিন্ন এলাকা হতে ক্যাশআউট করে সুমনের কাছে নিয়ে আসে। অতঃপর উক্ত টাকা তারা সবাই মিলে ভাগ করে নিত। এই চক্রটি ০২ বছর যাবৎ দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৬০-৭০ জন বিকাশ/নগদ এজেন্ট ব্যবসায়ীদের নিকট হতে অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে জানায়। তারা সবাই স্বল্প সময়ে কোটিপতি হবার আশায় এবং মাদক সেবনের অর্থ যোগান দিতে এই প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা যায়।

গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।