বাঙালি মুসলমানের রবীন্দ্র বিচার

Post Thumbnail

পাকিস্তান সৃষ্টির চার বছরের মাথায় মাহে-নও পত্রিকার আগস্ট ১৯৫১ সংখ্যায় সৈয়দ আলী আহসান ‘পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা সাহিত্যের ধারা’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তাতে তিনি বলেন, “আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবার এবং হয়তো বা জাতীয় সংহতির জন্য যদি প্রয়োজন হয়, আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছি। সাহিত্যের চাইতে রাষ্ট্রীয় সংহতির প্রয়োজন আমাদের বেশী।” পাকিস্তানবাদী বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের তরফে সেদিন যে-‘প্রস্তুতি’র কথা বলেছিলেন সৈয়দ আলী আহসান, দেড় দশকের ব্যবধানে তাই যেন সিদ্ধান্ত রূপে প্রকাশ পায় যখন ১৯৬৭ সালের ২১ জুন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন এক প্রশ্নের জবাবে জানান, ‘ভবিষ্যতে রেডিও পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান প্রচার করা হবে না এবং এ ধরনের অন্যান্য গানের প্রচারও কমিয়ে দেওয়া হবে।” কারণ ততদিনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতির বিপন্নতা তার চরম দশায় পৌঁছে গেছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানি শাসক ও তাদের মতানুসারী বুদ্ধিজীবীরা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের নামে পূর্ব বাঙলার মানুষকে বাঙালি সংস্কৃতির আবহমান ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াসটি জোরদার করার তাগিদ অনুভব করেন। ‘রাষ্ট্রীয় সংহতি’র স্বার্থেই সেটা তাঁদের কাছে জরুরি বলে মনে হয়। ইতিপূর্বে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী (১৯৬১) উদযাপন ও অন্যান্য উপলক্ষেও কমবেশি তাঁদের যে-উদ্দেশ্য বা মানসিকতার প্রকাশ ঘটে। আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা বারবার সে-ঘটনাগুলোর উল্লেখ বা তা স্মরণ করি। কিন্তু রবীন্দ্র-প্রতিভার মূল্যায়নে বাঙলার মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা কি বরাবর একই মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন? পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে, এমনকি পাকিস্তান আন্দোলনের তুঙ্গ পর্যায়েও, রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে এমনকি পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবীদেরও দৃষ্টিভঙ্গি কি একই রকম নেতিবাচক ছিল? বর্তমান নিবন্ধে সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও হবে আমাদের উদ্দেশ্য।

সাধারণভাবে হিন্দু লেখকদের বিরুদ্ধে মুসলমান সমাজ ও জীবনের প্রতি উপেক্ষা বা তার হীন চিত্রায়ন, ইতিহাস বিকৃতি, মুসলমান শাসকদের চরিত্র হনন কিংবা মুসলমান-শাসনের অবমূল্যায়নের অভিযোগ মুসলমান লেখক-বুদ্ধিজীবীদের তরফে গোড়া থেকেই করা হয়েছে। আর এ ব্যাপারে অভিযোগের প্রধান তীরটা নিক্ষিপ্ত হয়েছে বলা বাহুল্য বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি। তবে এরই পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথেরও ‘শিবাজী উৎসব’, ‘বন্দিবীর’, ‘হোরিখেলা’, ‘ভারততীর্থ’এর মতো রচনার প্রসঙ্গ টেনে তাঁর সম্পর্কেও মুসলমান-বিদ্বেষ প্রচারের অভিযোগ এনেছেন কেউ কেউ। যেমন সৈয়দ এমদাদ আলীর মতো মোটামুটি উদার মতের একজন সম্পাদক-লেখকও বলেছেন, “বাঙ্গালার প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথও এ ক্ষেত্রে বাদ পড়েন না।” (‘মাতৃভাষা ও বঙ্গীয় মুসলমান’, নবনূর, ১৯০৩) তাঁর রচনায় বাঙলার বৃহত্তর মুসলমান সমাজের অনুপস্থিতির কথা বলে অভিমান-ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছেন অনেকে। তবে নোবেল-বিজেতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বখ্যাতি লাভের ফলেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক অবদান থেকে নিজেদের বিযুক্ত করার কথা পরবর্তীকালে বিশিষ্ট কেউ বলেননি। বরং আমরা দেখি পূর্বোক্ত সৈয়দ এমদাদ আলীই কয়েক বছরের ব্যবধানে তাঁর অপর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথের দেওয়া জয়মাল্য শিরে ধারণ করিয়া আমাদের ভাষা-জননী গর্ব্বে স্ফীতা এবং আনন্দে আত্মহারা।” (‘বঙ্গীয় মুসলমান – বঙ্গভাষা ও মুসলমান’, বঙ্গীয়-মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, ১৯১৮) মাসিক মোহাম্মদীতকবির-এর মতো পত্রিকায় রবীন্দ্রসাহিত্যের বিরুদ্ধে ‘পৌত্তলিকতা’ প্রচারের অভিযোগ কিংবা রবীন্দ্র-প্রতিভার অবমূল্যায়ন করে অখ্যাত/স্বল্পখ্যাত কিংবা অদ্যাবধি-অজ্ঞাত ছদ্মনামধারী লেখকদের রচনাকে আমরা এই বিবেচনার বাইরে রাখছি।

২.
কোনো মুসলমান লেখকের তরফে রবীন্দ্র-প্রতিভার মূল্যায়নধর্মী যে-প্রথম মত বা মন্তব্যটির সন্ধান পাওয়া যায় তা আবদুল হামিদ খান ইউসফজয়ীর (১৮৪৫-১৯১০)। তিনি তাঁর কাব্যগ্রন্থ উদাসীর (১৯০০) ভূমিকায় বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্র-প্রতিভার অবস্থান বা বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করতে গিয়ে লেখেন, “জাতীয় সাহিত্য জগতের নন্দনকাননে বাস্তবিক তিনি [রবীন্দ্রনাথ – মোশহা] বাসন্তী পিক! ভাবের বিভোলে বিহ্বল হইয়া যে সকল সঙ্গীত গাথা তিনি দিবানিশি গাহিতেছেন, এবং যে সকল অমৃত লহরী অনবরত ঢালিয়া দিয়া বঙ্গের তাপিত প্রাণ শীতল করিতে প্রয়াসী হইয়াছেন, তাহা হইতে বিদগ্ধ ভারতের ভাগ্যে কালে অমৃত ফল যে না ফলিবেক এমন নহে।” (উদ্ধৃত : আবুল আহসান চৌধুরী, আবদুল হামিদ খান ইউসফজয়ী, ঢাকা : ১৪০৭)

এক্রামদ্দীনের (১৮৮২-১৯৪০) রবীন্দ্র-প্রতিভা বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে, অর্থাৎ, কবির নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পরের বছর। বাঙলা দেশে কোনো মুসলমান লেখকের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা প্রথম বই এটি। সেদিক থেকে এক্রামদ্দীনের ভূমিকা নিঃসন্দেহে পথিকৃতের। বইয়ে লেখক রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন (১৮৯০) নাটকটি নিয়ে দৃশ্যভিত্তিক আলোচনা করেছেন। একটিমাত্র রচনার আলোকে, তা-ও আবার রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভার মূল্যায়নের চেষ্টা কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, আর সমকালে কেউ কেউ সে-প্রশ্ন তুলেছেনও। তারপরও, নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, বইটির আলোচনায় প্রবাসী পত্রিকায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩২২) তখন যেমনটি বলা হয়েছিল, রবীন্দ্র-প্রতিভার ‘নিরপেক্ষ সমালোচনা’র একটি প্রয়াস লক্ষ করা যায়। এক্রামদ্দীনের মতে রবীন্দ্রনাথ তেমন একজন কবি ‘যাঁর রচনা কাব্যজগতে বিপ্লব আনয়ন করে’। পূর্ববর্তী কবিদের সঙ্গে তাঁর ‘বিস্তর প্রভেদে’র উল্লেখ করে এক্রামউদ্দীন লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের হৃদয় যুক্তিপ্রধান, ভাবপ্রধান নয়’; এবং “রবীন্দ্রনাথের সংযত ভাব ভাষাকে আজ্ঞানুবর্ত্তী মৃদুমন্দ গতিতে পরিচালিত করিয়াছে।” ইতিপূর্বে নবনূর পত্রিকার কার্তিক ১৩১১ সংখ্যায় ‘বঙ্গসাহিত্যে হিন্দু-মুসলমান’ শিরোনামাঙ্কিত এক রচনায় মোহাম্মদ হেদায়েতউল্লা মুসলমানের গুণকীর্তনে হিন্দু লেখকদের এককালীন অনীহার প্রসঙ্গ টেনে মন্তব্য করেন, “সুখের বিষয়, তাঁহারা এখন সে বিষয়েও পরাঙ্মুখ নহেন।” তাঁর এ-উক্তির সমর্থনে তিনি রবীন্দ্রনাথের কাহিনী (১৩০৬) কাব্যের অন্তর্ভুক্ত ক্ষুদ্র কাব্যনাট্য ‘সতী’র (১৩০৪) উদহরণ দেন। বলা বাহুল্য এসবই প্রথমদিকের মুসলমান লেখকদের দ্বারা রবীন্দ্র-প্রতিভার ইতিবাচক মূল্যায়নের নজির।

৩.
ঢাকা মুসলিম সাহিত্য-সমাজ বা শিখা-গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত লেখকদের প্রায় সকলেই ছিলেন যাকে বলে রবীন্দ্রভক্ত। গঠিত হওয়ার পর সাহিত্য-সমাজের প্রথম বা উদ্বোধনী অধিবেশনেই (১৯২৬ এর ৩১ জানুয়ারি) ‘রবীন্দ্রকাব্যের স্বরূপ’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন এম. তাহেরউদ্দীন। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত অধিবেশনে পঠিত প্রবন্ধটির ওপর আলোচনায় অংশ নেন অন্যান্যের মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ, আবদুল কাদির ও এ এফ এম আবদুল হক। কাজী ওদুদ তাঁর আলোচনায় বলেন, “বড় কবিকে বুঝতে হলে বড় চিত্ত চাই।” ১৯২০ এর দশকের গোড়ায় ঢাকায় মনোরঞ্জন চৌধুরী কর্তৃক ‘বিশ্বভারতী সম্মিলনী’ গঠিত হলে, প্রায় গোড়া থেকেই কাজী আবদুল ওদুদ ও আবুল ফজল এই সমিতি ও তার বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হন। কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর রবীন্দ্র কাব্যপাঠ (১৯২৭) গ্রন্থের খসড়াটি এই সংগঠনের কয়েকটি অধিবেশনেই পাঠ করেন, যা পরে পরিমার্জিত হয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রবাসীর চারটি সংখ্যায় (অগ্রহায়ণ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র ১৩৩২) প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ এ-প্রবন্ধের উপসংহারে কাজী আবদুল ওদুদ লেখেন : “রবীন্দ্রনাথ আজ বিশ্ববিখ্যাত পুরুষ। তাঁর খ্যাতিতে বাঙালী গৌরবান্বিত। কিন্তু তাঁর এ খ্যাতিকে সত্যকার খ্যাতিতে রূপান্তরিত করবার, অর্থাৎ, তাঁর প্রতিভাকে একটা জাতির জীবনের বস্তু ক’রে তাকে সার্থকতা দান করবার, শ্রেষ্ঠ অধিকার যে বাঙালীরই আছে এ কথা ভুল্লে চল্বে না। বাঙালীর অত্যন্ত অসম্পূর্ণ জাতীয়জীবন ও সাহিত্যের জন্য এর প্রয়োজন বড় বেশী।” কাজী ওদুদ তাঁর বাকি জীবনে পবিত্র দায়িত্বজ্ঞানে ও গভীর নিষ্ঠায় রবীন্দ্র-প্রতিভার এ পরিচয় তুলে ধরার কাজটি করে গেছেন। রবীন্দ্র কাব্যপাঠ-এর পর প্রকাশিত হয় দুই খণ্ডে তাঁর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ (১ম খণ্ড : ১৯৬২, ২য় খণ্ড : ১৯৬৯)। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বাড়ির কাছের মুসলমানদের জন্য কী করেছেন’ এ-ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েও তাঁর জবাব :

যেহেতু রবীন্দ্রনাথ কবি, এবং যেহেতু মুসলমান মানুষ, সেজন্যে মুসলমান তার আজকার বিশেষ ঐতিহাসিক বিবর্তনের প্রভাবে বুঝুক আর নাই বুঝুক, রবীন্দ্রনাথ বাস্তবিকই তার পরম বন্ধু ব্যতীত আর কিছু নন।

এবং

… মুসলমানীর অর্থ যদি হয় সত্যপ্রীতি, কাণ্ডজ্ঞান-প্রীতি, মানবপ্রীতি, জগৎপ্রীতি, ন্যায়ের সমর্থন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ, তবে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় মুসলমান এ যুগে আর কেউ জন্মেছেন কি না সে-কথা এই সব সমালোচকদের গভীর বিচার-বিশ্লেষণের বিষয় হওয়া উচিত।
(‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান-সমাজ’, ১৯৪১)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা সফরে এলে, ১০ ফেব্রুয়ারি, মুসলিম হলে তাঁকে যে-সংবর্ধনাটি দেওয়া হয়, হল-প্রাধ্যক্ষ এ এফ রহমানের কথা বাদ দিলে, তার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন ও আবুল ফজল। সংবর্ধনা সভায় রবীন্দ্রনাথকে প্রদত্ত মানপত্রটি আবুল হুসেনেরই লেখা। উক্ত মানপত্রে যাঁর কাছে ‘হিন্দু নাই, মুসলমান নাই, খ্রিস্টান নাই’ রবীন্দ্রনাথকে তেমন এক ‘বিরাট-প্রাণ মহাপুরুষ’, ‘জাতীয়তার পুরোহিত ও বীর’ হিসেবে সম্বোধন এবং তাঁর সৃষ্টিসম্ভারকে ‘শুধু বাঙ্গালীর নয়, শুধু হিন্দুর নয়, শুধু ভারতবাসীর নয়—বিশ্বমানবের’ বলে উল্লেখ করে বলা হয় :

তুমি আশীর্বাদ কর, যেন তোমার অপূর্ব সৃষ্টির আনন্দ আমাদের উষর-শুষ্ক চিত্তে পৌঁছিতে পারে; চিরন্তন মানবের অধিকারে আমরা তাহাকে গ্রহণ করিতে পারি—আপনার করিতে পারি এবং তাহার দ্বারা আমাদের রস-বিমুখ, শ্রীহীন এই জীবন সরল-সুন্দর করিয়া তুলিতে পারি। … আমরা যেন শাস্ত্র ও কাল, জাতি ও দেশের ক্ষুদ্র সীমার বাহিরে গিয়া মানুষের দানকে নির্বিকারচিত্তে আপনার করিয়া গ্রহণ করিতে প্রবৃত্ত হই। ‘জ্ঞানের রাজ্যে অসহযোগ (Non-co-operation) মৃত্যু’ তোমার এই অমর উপদেশ যেন আমরা কখনও বিস্মৃত না হই।

মানপত্রে আরও বলা হয়, হজরত মুহম্মদের (স.) জীবনের মূলমন্ত্র ‘কর্মের মধ্যে মুক্তি’র বার্তা ‘তামসিক ভারতে’ রবীন্দ্রনাথই নতুন করে ঘোষণা করেছেন। সংবর্ধনার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ যা বলেন তাও এ-প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য : “… পাশ্চাত্ত্য দেশে আমি মানবের কবি ব’লে সমাদৃত। তার কারণ কোন সম্প্রদায় বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হ’য়ে আমি কোন কার্য করি নি। … মানুষ সেইখানে শ্রদ্ধেয়, যেখানে মানুষ সকলের হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছে বিশ্বের মধ্যে, সঙ্কীর্ণতার মধ্যে নয়। … আপনাদের নিকট আমার যে পরিচয় তার কারণ আমি মানুষের সঙ্কীর্ণতার বাহিরে নিজেকে প্রকাশ করতে পেরেছি।”

শিখা গোষ্ঠীর পুরোধাদের মধ্যে যিনি ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ সেই কাজী আনোয়ারুল কাদীর তাঁর ১৯৩০ সালে লেখা প্রবন্ধ ‘সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা’য় বাংলা সাহিত্যে সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতের অভিযোগকে মোটামুটি যথার্থ বলেই মনে করেছেন। তাঁর মতে বাঙলা দেশে সাম্প্রদায়িক বিরোধের জন্য ‘বাংলা সাহিত্যও অনেকখানি দায়ী’। তাঁর একমাত্র প্রবন্ধ-সংকলন আমাদের দুঃখ-এর (১৯৩৪) অপর এক প্রবন্ধ ‘জাতীয় সমস্যা’য় মানুষকে ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলমান’ পরিচয়ে ভাগ করে দেখা যে ‘রাষ্ট্রিক মহাজাতি’ গঠনের পথে একটি বড় বাধা রবীন্দ্রনাথের এ-মতকে সমর্থন করে তিনি বলেছেন, কবির এই প্রেমের আহ্বান ‘হৃদয়হীন হিন্দু মুসলমানের প্রাণে কোনো সাড়া জাগায় নি’। শিখা গোষ্ঠীর অন্যান্য প্রধান লেখক, যেমন কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী ও আবুল ফজল ছিলেন আমৃত্যু রবীন্দ্রানুরাগী। এঁদের মধ্যে কাজী ওদুদ ছাড়া বাকি তিনজনই ১৯৪০ এর দশকের শেষ নাগাদ ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক। আবুল ফজল তো ১৯৪৫ সালে মাসিক মোহাম্মদীর ‘কায়েদে আজম সংখ্যা’র জন্য একটি নাটকই লেখেন ‘কায়েদে আজম’ নামে, যা পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানোত্তর পর্বে, কিছু কালের জন্য হলেও, কাজী মোতাহার হোসেন তমদ্দুন মজলিশের সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু সেদিনকার পরিস্থিতিতে উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যার অবিকল্প সমাধান হিসেবে পাকিস্তান দাবিটিকে বিবেচনা করলেও, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আর পাঁচটি প্রশ্নে তাঁরা বুদ্ধিমুক্তির চেতনাকেই লালন করেছেন। রবীন্দ্র-মূল্যায়নেও তাঁরা বরাবর উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সংস্কৃতি-কথা গ্রন্থের ২৯টি প্রবন্ধের মধ্যে ৫টিই রবীন্দ্রবিষয়ক। তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথ ‘শুধু কবি নন, মহাপুরুষ’, আর ‘শুধু মহাপুরুষ না বলে’ তাঁকে ‘আধুনিক অথবা বিকাশধর্মী মহাপুরুষ বলা উচিত’। (‘রবীন্দ্রনাথ’) প্রগতিচর্চার নামে রবীন্দ্র-প্রতিভার একমাত্রিক মূল্যায়ন বা বিচারেরও সমালোচনা করে তিনি লিখেছেন :

পাকিস্তানে কবি ইকবালকে রাষ্ট্রভিত্তি করে তলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। পশ্চিম বাংলায় বা ভারতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনুরূপ চেষ্টা চলবে কিনা বলতে পারি নে। …

একব্যঞ্জনীদের পক্ষে বহুব্যঞ্জনী রবীন্দ্রনাথকে বোঝা কঠিন। অথচ তাঁরাই তাঁর জয়ন্তী পরিচালনার ভার নেন। ধার্মিকদের মতো তাঁদের মনও সরলীকরণের দিকে। সত্য তো একরকমের হবে, বিভিন্ন রকমের হবে কেন, এ কথা ভেবে তাঁরা বোকা ব’নে যান। জীবনের বিচিত্র ভোজে যাঁদের নিমন্ত্রণ নেই, তাঁদের যে এ দশা হবে তাতে আর আশ্চর্য কি!

একব্যঞ্জনী প্রাগতিকরা যে কেবল রবীন্দ্রনাথের ওপর জুলুম চালান তা নয়, অপরাপর সাংস্কৃতিক ব্যাপারেও তাঁরা একই মনোভাবের পরিচয় দিয়ে থাকেন। তাঁদের সাম্যনীতির জোয়ারে সব কিছুই একাকার হয়ে যায়।
(‘অহমিকা- সৌন্দর্য-চেতনা – রবীন্দ্রনাথ’)

আবুল ফজলের রবীন্দ্রচর্চার শুরু সম্ভবত ১৯৩৩ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র-জীবনীর (১ম খণ্ড : ১৯৩৩) একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। যাতে তিনি লেখেন : রবীন্দ্রনাথের জীবনী “কোন একজন ব্যক্তি বিশেষের জীবন-কথা নয়, বরং একটি জাতির যুগ বিশেষের ইতিহাস।” এবং তাঁর “সুদীর্ঘকালব্যাপী জীবনে দেশে এমন কোন অনুষ্ঠান, এমন কোন আন্দোলন আসেনি যার সাথে রবীন্দ্রনাথের মন সাড়া দেয়নি, যা তাঁর প্রতিভার স্পর্শে সমৃদ্ধ হয়নি।” এর তিন দশক পর রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে মুসলমান সমাজের প্রতি বিরূপতা বা উদাসীনতা প্রকাশের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে আবুল ফজল লিখছেন, “কবি হিসেবে তাঁর দিকে না তাকিয়ে, নিজেদের ইচ্ছানুগ কল্পনার সঙ্গে রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্দেশ্য মিশিয়ে মতামত দিতে গিয়েই এ বিভ্রাটের সৃষ্টি।” (‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলিম সমাজ’, ১৯৬৫) আর, তাঁর মতে, “বাংলা ভাষাভাষীদের পক্ষে রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে না চাওয়া বা সে সম্বন্ধে অনীহা থাকার মতো ক্ষতি কল্পনা করা যায় না।” (প্রাগুক্ত)

সাম্প্রদায়িক বিবেচনা প্রসূত রবীন্দ্র-বিরোধিতার অংশ হিসেবে নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাবার একটা অপচেষ্টা পাকিস্তানোত্তরকালে বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। এর মোকাবেলায় কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন, “রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক প্রতিদ্বন্দ্বীর ছিল না, ছিল গুরু-শিষ্যের মত। … দেশের সবাই যখন তাঁকে [নজরুলকে — মোশহা] পরিহাস করছিলেন রবীন্দ্রনাথই তাঁকে যথার্থ বুঝতে পেরেছিলেন।” (‘আমার বন্ধু নজরুল : তাঁর গান’) জানিয়েছেন, “প্রথম যৌবনে নজরুল রবীন্দ্রনাথের গানকে সবকিছুর উপর স্থান দিয়েছিলেন।” (প্রাগুক্ত) অবশ্য এরই পাশাপাশি রবীন্দ্র জন্ম-শতবর্ষে লেখা অপর এক প্রবন্ধে কাজী মোতাহার হোসেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরের বিশুদ্ধতা রক্ষার নামে এক শ্রেণীর রবীন্দ্রানুসারীর বাড়াবাড়ি বা শুচিবায়ুগ্রস্ততারও সমালোচনা করেন। (‘রবীন্দ্র সঙ্গীত’)

৪.
ঘোরতররূপে পাকিস্তানবাদী এবং পরবর্তীকালে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তারূপে যে-সব কবি-লেখকের আবির্ভাব তাঁদেরও কেউ কেউ প্রাক-পাকিস্তান পর্বে তাঁদের রবীন্দ্র-অনুরাগ প্রকাশ এবং রবীন্দ্র-প্রতিভার ইতিবাচক মূল্যায়নে অকুণ্ঠচিত্ততার পরিচয় দিয়েছেন। এ-প্রসঙ্গে আমরা এখানে দুজনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে পারি : গোলাম মোস্তফা ও আবুল কালাম শামসুদ্দীন। কি পাকিস্তান-পূর্ব কি পাকিস্তানোত্তর পর্বে নজরুল প্রসঙ্গে ‘পৌত্তলিক ভাবধারা ও প্রকাশভঙ্গি’ অনুসরণ এবং ‘হিন্দু ও হিন্দুয়ানি-প্রীতি’র অভিযোগ পুনঃপুনঃ ও জোরালোভাবে করলেও, গোলাম মোস্তফা এমনকি তাঁর ১৯৪০ এর দশকে প্রকাশিত প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথ ও অতীয়ন্দ্রবাদ’-এও (১৯৪৩) রবীন্দ্রকাব্য পাঠের উপকারিতার কথা বলেছেন। ইতিপূর্বে বঙ্গীয়-মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার শ্রাবণ ১৩২৯ সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তিনি রবীন্দ্র কবিতার ভাব ও আদর্শের সঙ্গে ইসলামের ‘চমৎকার সৌসাদৃশ্য’এর উল্লেখ করে লেখেন, “তাঁহার [রবীন্দ্রনাথের — মোশহা] ভাব ও ধারণাকে যে-কোন মুসলমান অনায়াসে গ্রহণ করিতে পারে। বাংলা ভাষায় আর কোন কবি এমন করিয়া মুসলমানের প্রাণের কথা বলিতে পারেন নাই।” উক্ত প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মুসলমানদের ‘গর্ব করবার যথেষ্ট কারণ আছে’ বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে যেভাবে দেখেছেন তা ‘ইসলামের সম্পূর্ণ অনুমোদিত’; এবং ‘পৌত্তলিকতা, বহুত্ববাদ, নিরীশ্বররবাদ, জন্মান্তরবাদ, সন্ন্যাসবাদ প্রভৃতি’ ইসলাম বিরোধী ধারণা ‘রবীন্দ্রনাথের লেখায় অনুপস্থিত বললেও অত্যুক্তি হয় না’। অথচ একই গোলাম মোস্তফা তাঁর পাকিস্তানোত্তরকালে রচিত প্রবন্ধ ‘ইকবাল ও রবীন্দ্রনাথ’-এ (১৯৬০) সম্পূর্ণ ভিন্ন বক্তব্য উপস্থাপন করেন। রবীন্দ্র-কাব্যের প্রেরণা ও দর্শনকে ‘মধ্যযুগীয়’ বলে উল্লেখ করে তিনি লেখেন, “যে-কারণে ইকবাল প্লেটো বা হাফিজকে আমল দেননি, ঠিক সেই কারণে আমরা রবীন্দ্রকাব্যকেও আমল দিতে পারি না।”

আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯২০ এর দশকে লেখা তাঁর ‘কাব্য-সাহিত্যে বাঙালী-মুসলমান’ প্রবন্ধে (সওগাত, ১৩৩৩-৩৪) লিখেছিলেন, “কবির সৃষ্টি সুন্দর হইল কিনা, তাহাতে বিশ্বমানবের কোন মঙ্গল নিহিত আছে কিনা এবং কোন সত্যের দিকে উহা অঙ্গুলি নির্দেশ করিতেছে কিনা, ইহাই হইল কাব্য যাচাই করিবার মাপকাঠি। সুতরাং কাব্যে অনৈসলামিকতার দোষারোপ আমরা ঠিক বুঝিতে পারি না।” যাঁরা সে রকম দোষারোপ করেন, তাঁদের সে ‘উদ্ভট প্রয়াসে’র সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন, “পারস্য-সাহিত্যে হাফেজ-ওমর খৈয়াম প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ কবিগণের কাব্যে ইসলামী অনুশাসনের খেলাপ কথা আছে বলিয়া কোন সমালোচক তাঁহাদিগকে কবি হিসাবে শ্রদ্ধা অর্পণ করিতে ত্রুটী করেন নাই। কেবল বাঙ্গলা দেশেই কাব্য সম্বন্ধে এই সার্বজনীন মতের ব্যতিক্রম দেখা যায়।” কাব্যে বা সাহিত্যে যাঁরা ইসলামি অনুশাসনের গুণ-গরিমার ব্যাখ্যান কিংবা ইসলামি সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ খোঁজেন, তাঁদেরকে তিনি বরং ‘কাব্য না পড়ে ইতিহাস পড়তে’ উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আবুল কালাম শামসুদ্দীনকেই আমরা দেখি ১৯৬৭ সালের রবীন্দ্রসংগীত বিতর্ককালে পাকিস্তানের তামুদ্দুনিক স্বাতন্ত্র্যের যুক্তিতে তথ্যমন্ত্রীর ঘোষণাকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতিদাতাদের অন্যতম হিসেবে।

এমনকি, তাঁদের সুপরিচিত সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবাদী অবস্থান সত্ত্বেও, রবীন্দ্রজন্ম শতবর্ষ (১৯৬১) উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র প্রশস্তিমূলক বক্তব্য রেখেছেন, রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া বাংলা সাহিত্য ‘অর্থহীন’ এমন অভিমত প্রকাশ করেছেন, সে-রকম অন্তত দুজন বুদ্ধিজীবী সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ও হাসান জামানকে কয়েক বছরের ব্যবধানে রবীন্দ্রসংগীত বিতর্ককালে ভিন্ন অবস্থানে দেখা যায়। এর তাৎপর্য বুঝতে আমাদের অসুবিধা হবে না যদি আমরা আরও পরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায়ও তাঁদের ভূমিকাটিকে স্মরণে বা বিবেচনায় রাখি।


অবশ্য আমাদের মনে রাখা উচিত, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের এই ইতিবাচক-নেতিবাচক মূল্যায়ন-সমালোচনার সমসময়ে তাঁর আপন সম্প্রদায়ের মানুষের কাছ থেকেও তিনি কম নিন্দা-বিদূষণের শিকার হননি। যার উল্লেখ করে সত্তরতম জন্মজয়ন্তীতে তাঁর অভিমানক্ষুব্ধ উচ্চারণ : “এমন অনবরত, এমন অকরুণ, এমন অপ্রতিহত অসম্মাননা আমার মতো আর কোনো সাহিত্যিককেই সইতে হয়নি।” (‘আত্মপরিচয়’) তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আগেই অক্ষয়চন্দ্র সরকার, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখের হাত দিয়ে যার শুরু, তাঁর মৃত্যুর সত্তর বছর পর আজও রবীন্দ্র-বিরোধিতার সে ধারা কমবেশি অব্যাহত আছে। আর বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাস, সজনীকান্ত দাস, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, রমাপ্রসাদ চন্দ, শিবরাম চক্রবর্তী, নীরদচন্দ্র চৌধুরী, ভবানী সেন (রবীন্দ্র গুপ্ত), বিনয় ঘোষ, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শিবনারায়ণ রায়ের মতো তাবড় তাবড় মানুষ আগেপরে ‘রবীন্দ্র-বিদূষণে’র এই মিছিলে শরিক হয়েছেন (এঁদের কেউ কেউ অবশ্য পরে তাঁদের অবস্থান পরিবর্তন, বক্তব্য প্রত্যাহার করেন)। সাহিত্য, নারায়ণ, কল্লোল, শনিবারের চিঠি, প্রগতি, পরিচয়, নতুন সাহিত্য, মার্কসবাদী প্রভৃতি পত্রিকাকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা এই রবীন্দ্র-বিতর্কে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায়ে কখনো ‘অস্পষ্টতা’, ‘দুর্বোধ্যতা’ বা ‘হেঁয়ালিপনা’র, কখনো ‘অশ্লীলতা’ বা ‘দুর্নীতি’র, আবার কখনো প্রতিক্রিয়াশীলতা বা প্রতিবিপ্লবীয়ানার — গণবিরোধিতা, সামন্ত-স্বার্থের পোষকতা, ঔপনিবেশিক প্রভুদের তোষণ ইত্যাদি অভিযোগ উত্থাপিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টির সশস্ত্র সংগ্রামপন্থী রণদিভে-লাইন এবং এ-সময় চলমান বামপন্থী প্রগতি সাহিত্য-আলোচনার প্রভাবে ১৯৪০-৫০ দশকে রবীন্দ্র-বিরোধিতার ঢেউ পূর্ব বাঙলার প্রগতিবাদী লেখক-সংস্কৃতি কর্মীদেরও আক্রান্ত করে। মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, আখলাকুর রহমান ও আবদুল্লাহ আল মুতীর মতো প্রগতি-কর্মীরা যার শিকার হন (এঁদের সঙ্গে একমত হতে না পারায় ঢাকা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সভাপতি অজিত গুহকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়)। বিভাগোত্তর পূর্ব বাঙলায় বামপন্থীদের এই রবীন্দ্র-বিরোধিতা অবশ্য খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। কারণ অচিরেই তাঁদেরকে এক প্রবল প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করতে হয়, ধর্ম-সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে যারা শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, সামগ্রিকভাবে বাঙালি সংস্কৃতি এমনকি বাংলা ভাষাকেও তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।


পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্বাভাবিকত্ব সম্পর্কে ধারণা বা এক রকম সচেতনতা এবং এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ বা আশঙ্কা থেকেই খুব সম্ভব পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতিত্ত্বের (‘ভারতবর্ষে দুটি জাতি হিন্দু ও মুসলমান’ : যা আসলে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদে’র এন্টিথিসিস) ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরই দেশের মানুষকে প্রথমে তাদের হিন্দু-মুসলমান পরিচয় ভুলে এক ‘পাকিস্তানি’ জাতীয়তার ছাদনাতলায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান (১৯৪৮ সালের ১১ আগস্ট গণপরিষদে ভাষণ)। পরবর্তীতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির মুখে তিনিই আবার বলেন, “আমরা যদি নিজেদেরকে প্রথমে বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি ইত্যাদি মনে করে শুধু প্রসঙ্গক্রমে নিজেদেরকে পাকিস্তানি ভাবতে শুরু করি, তাহলে পাকিস্তান ভেঙে যেতে বাধ্য।” (১৯৪৮ সালের ২৮ মার্চ প্রদত্ত বেতার- বক্তৃতা) জিন্নাহর উত্তরসূরিরাও পরবর্তীকালে সেই একই আশঙ্কা বা মনোভাবের দ্বারা চালিত হয়ে প্রায় একই বক্তব্য ও আচরণের পুনরাবৃত্তি করে গেছেন। দেশের সংখ্যগরিষ্ঠ মানুষের বাস যেখানে সেই পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের জনগণকে তাদের বাঙালি পরিচয়টি যথাসম্ভব ভুলিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের ভাঙন রোধ করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। আর পূর্ব বাঙলার মানুষকে আবহমান বাঙলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিশেষ করে রবীন্দ্র-সাহিত্যের সমৃদ্ধ ও সুমহান উত্তরাধিকার থেকে বিযুক্ত করার প্রয়াস ছিল তাদের সে অভিপ্রায়েরই অংশ। আমাদের স্বাতন্ত্র্যবাদী লেখক-বুদ্ধিজীবীদের দু-চারজন হয়তো স্বার্থবুদ্ধির বশে তবে বেশিরভাগই নিজস্ব সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পাকিস্তানি শাসকদের সে-অভিসন্ধি বাস্তবায়নে তাদের সঙ্গে শরিক হয়েছিলেন। দীর্ঘ একনায়কত্ববাদী ও সামরিক শাসন, ক্রমবর্ধমান শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক অবদমনের মুখে একদিকে যেমন বাঙালির প্রতিরোধ চেতনা জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষার রূপ নিয়ে শত শিখায় জ্বলে উঠতে থাকে, তেমনি পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবীরাও এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন। সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্যচেতনাকে জোরদার করার মাধ্যমেই তাঁরা এই ‘দুরবস্থা’ থেকে পরিত্রাণের উপায় খোঁজেন। যা কার্যত ভুল প্রমাণিত হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সহযোগীরা বেতারে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। প্রতিক্রিয়ায় এদেশের মানুষ আরও বেশি করে রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরে। রবীন্দ্রনাথের গান কণ্ঠে নিয়ে তাঁরা যুদ্ধ করেছে। সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত দেশে রবীন্দ্রনাথের একটি গানকেই তারা জাতীয় সংগীত হিসেবেও বেছে নিয়েছে।

(২০১১)

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, ইতিহাসবিদ