রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : বাংলা সাহিত্যের রাজাধিরাজ

Post Thumbnail

“আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি বসি পড়িছ আমার কবিতাখানি
কৌতুহল ভরে—”

রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা সাহিত্য অচিন্তনীয়, অকল্পনীয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখনীতে বিশ্বসাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের যেটুকু অর্জন, তা অন্যকারো হাত দিয়ে সম্ভব হয়নি। আর তাই, বিশ্বসাহিত্যের মঞ্চে বাংলা ভাষাার মর্যাদাকে সর্বোচ্চ স্তরে তুলে ধরার একক কৃতিত্বটুকু তাঁরই, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাঁর রচিত কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ — বাংলা সাহিত্যে তাঁর রাজ্য এবং রাজত্ব, দুটোই আজো অক্ষুন্ন। আজও জ্ঞান পিয়াসী চাতকেরা তাঁর কাব্যরসের অমিয় সুধা পান করে চলেছেন। মদিরার নেশার মত তাঁর গানের সুরে

মাতাল হয়ে জীবনের সুখ খুঁজে নিচ্ছেন। এমনই এক চিরঞ্জীব সাহিত্যের স্রষ্টা তিনি।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য যেন একই সাথে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে আধ্যাত্মিকতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ দর্শনের চমৎকার মেলবন্ধন। একই সাথে মানব মর্যাদাকে সর্বাগ্রে ধারণ করে বলিষ্ঠ কন্ঠে স্রষ্টার প্রতি প্রার্থনায় তিনি বলে ওঠেন—

“চিত্ত যেথা ভয়শূণ্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর।”

আবার কত সুন্দর ভাবে তিনি একটা শিশুমনের কল্পনাকে কবিতায় তুলে ধরতে পারেন, তার প্রমাণ পাই বীরপুরুষ কবিতায় এভাবে—

“মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে,
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।”

কত সহজ-সরল অথচ কী গভীর মমতা দিয়ে তিনি ধারণ করেছেন কবিতার প্রতিটি কথা, প্রতিটি চরণ! এভাবে তিনি তাঁর রচনায় স্রষ্টাার প্রতি সৃষ্টির প্রেম, মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম, মায়ের প্রতি সন্তানের প্রেম এবং দেশপ্রেম—সবগুলোকে কাব্যের সুতোয় গেঁথে আমাদের বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে গেছেন বিশ্বসাহিত্যের কাতারে।

রবীন্দ্রনাথের গান সম্পুর্ণ বাংলা সাহিত্যে অনন্য। তাঁর গানে প্রেম, প্রকৃতি, আত্মান্বেষণ, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে। এসব গান আমাদের অন্তরকে স্পর্শ করে আমাদেরকে নতুন আলোর দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাঁর গানে আমরা যেভাবে একই সাথে প্রকৃতিপ্রেম, মানব প্রেম বা দেশপ্রেমকে পাই, তা পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সাহিত্যে বিরল। আমাদের জাতীয় সংগীতসহ অনেক দেশাত্ববোধক গানে যে মমত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন, তা অতুলনীয়।

“ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা॥”

কী উপলব্ধি! কী মায়া আর মমতা দিয়ে জড়িয়ে ধরা প্রতিটি কথা যেভাবে আমাদের দেহ মনে এক অবর্ণনীয় শিহরণ জাগায় তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?

একজন ছোট গল্পকার হিসেবেও তাঁর প্রতিটি গল্পই বিশ্বমানের। হৈমন্তী, অপরিচিতা,কাবুলিওয়ালা বা তোতা কাহিনী—প্রত্যেকটি গল্পের পটভুমি,চরিত্র,কাহিনী বিন্যাস এবং আকস্মিক সমাপ্তি যেন বলে দিচ্ছে , ‘শেষ হইয়া্ও হইলনা শেষ!’ তাঁর গল্প লেখনীর শক্তিশালী বুনটে আমরা তাঁর মাঝে পাই পাশ্চাত্য সাহিত্যিক জন মিল্টন, ও হেনরী, মার্জারি কিনান রলিং কিংবা উইলিয়াম সেক্সপিয়ারকে।

আবার আমরা যদি তাঁর রচিত নাটক গুলোর দিকে তাকাই তাহলে সেখানেও তাঁর মুন্সিয়ানার পরিচয় মেলে। তাঁর নাটক প্রধানত ভাবাত্মক, গীতিধর্মী এবং তত্ত্বচিন্তাবাহী। তাঁর নাটকে সমকাল সমাজ ও ব্যক্তিসমস্যার নানান জটিল অবস্থা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি সমকালীন সমাজ ও ব্যক্তির চরিত্রকে নাট্যরুপে চিত্রিত করেছেন কয়েক ভাবে। ‘গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য ও নাট্যকাব্য – এ তিন ধারায় রচিত নাটকগুলো বাংলা সাহিত্যের এক একটি অমূল্য সম্পদ।

বাংলা সাহিত্যের সমকালীন লেখকদের তুলনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা উপন্যাসের ভাষা ও কাহিনী বিন্যাস সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল হওয়ায় খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। ১৮৮৩ সাল থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যকার এই সময়কালে তিনি মোট ১৩টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন যার মধ্যে ’করুণা’ নামে তাঁর একটি অসমাপ্ত উপন্যাসও রয়েছে। ‘নৌকাডুবি’,’গোরা’,’ চতুরঙ্গ’ সহ প্রতিটি উপন্যাসই এখনও অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর লেখা ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসটি যেন মানব জীবন দর্শনের একটা সেরা উপাখ্যান। উপন্যাস গুলির পটভুমি, কাহিনী ও চরিত্র বিন্যাস সমসাময়িক হলেও বিশ্বসাহিত্যের মানদন্ডে সর্বজনীন। আর এভাবেই তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় নিপুণ স্রষ্টার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েই পদচারণা করেছেন সগৌরবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের রাজাধিরাজ। তিনি একাধারে একজন ভাষাবিদ, একজন অমর সংস্কৃতিবিদ, একজন দার্শনিক, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, অভিনেতা, শিক্ষাবিদ এবং একই সাথে একজন মানবিক সমাজকে আলোকিত করার পথ প্রদর্শক। তাঁর কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, ছোট গল্প, গদ্য রচনাবলী সবই বিশেষ ঔজ্জ্বলতা ও আধ্যাত্মিক সত্ত্বায় দ্যূতিময়। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক একটি অমূল্য সম্পদ। প্রতিটি রচনা যেমন একদিকে মানুষের হৃদয়ে আলোকিত সত্যের সন্ধান দেয়, তেমনি প্রেম, স্বাধীনতা, প্রকৃতির সাথে একাত্মতা, মানুষের আন্তরিকতা ও মানব জীবনের প্রতিটি দিককে উদ্ভাসিত করে তোলে।

একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত দিয়ে বিশ্ব সাহিত্যেরভাণ্ডারে বাংলাভাষার যে সম্পদ গচ্ছ্বিত রাখা হয়েছে, তাতে যতদিন পৃথিবীতে বাঙালি ও বাংলা ভাষার অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন বিশ্ব সাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের অবদান চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

লেখক : শিক্ষক ও সাংবাদিক