ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

Post Thumbnail

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘একটি শিশির বিন্দু’ কবিতাখানি প্রায় প্রতিটি বাঙালিই জানে। বহুল চর্চিত এবং পঠিত একটি কবিতা। ১৩৩৬ সনে শান্তিনিকেতনে বসে তিনি এটি লিখেছিলেন। এই কবিতা লেখার পেছনের যে গল্প তা কেউ কেউ জানেন আবার অনেকেই জানেন না। আর সেই গল্পের যে মধ্যমনি তিনি আর কেউ নন, বাঙালির আরেক গর্বের ধন বিশ্ববিখ্যাত অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়।

রায় পরিবার এবং ঠাকুর পরিবারের সখ্যতা অনেকদিনের। সত্যজিৎ রায়ের জন্মেরও বহু আগে। সত্যজিৎ রায়ের দাদামশাই উপেন্দ্রকিশোয় রায় চৌধুরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর বন্ধুত্ব ছিল। ময়মনসিংহ থেকে ১৮৭৯-৮০ সাল নাগাদ উপেন্দ্রকিশোর কলকাতায় এসেছিলেন এন্ট্রান্স পাশ করে আইএ পড়তে। কলকাতায় এসে উঠেছিলেন ৫০, সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে যেটা ছিল ব্রাহ্মদের আখড়া। ব্রাহ্মসমাজ তখন অনেকটাই দ্বিধাবিভক্ত। সেই সময় ঠাকুর বাড়ির দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের যোগাযোগ হয় এবং ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াতের গোড়াপত্তন ঘটে। উপেন্দ্রকিশোরের সূত্র ধরেই তদীয় পুত্র সুকুমার রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যলাভ করেন। ক্রমেই দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।

১৯২১ সাল ছিল সেটি। সুকুমার রায় সেবার কালাজ্বরে আক্রান্ত হন। সেই বছরেই দুর্গা পূজার সময় শিশুপুত্র মানিককে নিয়ে সপরিবারে সুকুমার রায় শান্তিনিকেতনে যান রবিঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। তারও দুই বছর পর অর্থাৎ ১৯২৩ সনে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। মানিক অর্থাৎ সত্যজিৎ রায় তখন নিতান্তই শিশু। সুকুমার রায়ের মৃত্যুশয্যায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখতে যান এবং সুকুমার রায়ের ইচ্ছেতে রবিঠাকুর তাঁকে গান গেয়ে শোনান। এ থেকেই বোঝা যায় দুই পরিবারের নৈকট্য।

সত্যজিৎ রায়ের মা সুপ্রভা রায় ছিলেন রবীন্দ্র অন্তপ্রাণ। শান্তিনিকেতন ছিল তাঁর কাছে পূণ্যভূমিসম। একবার শিশু মানিককে নিয়ে তাঁর মা শান্তিনিকেতনে গেলেন পৌষমেলা উপলক্ষে। পুত্রকে নিয়ে গেলেন গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে। সত্যজিৎ রায় সেই স্মৃতিকথা’র বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে—

“রবীন্দ্রনাথকে আমি প্রথম কখন কাছ থেকে দেখি তা আমার মনে নেই। যখনকার কথা মনে আছে তখন আমার বয়স সাত বছর। মা-এর সঙ্গে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম পৌষের মেলায়। সঙ্গে হোয়াইটআওয়ে লেডল-র দোকান থেকে কেনা নতুন অটোগ্রাফের খাতা। রবিবাবু নাকি খাতা দিলেই তখন তখন কবিতা লিখে দেন, তাই ভারি শখ আমার খাতার প্রথম পাতায় তাঁকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেব।”

সেদিন দেখা হতেই প্রণাম সেরে ছোট্ট মানিক রবিঠাকুরের সামনে সদ্যকেনা অটোগ্রাফের খাতাটি বাড়িয়ে দিলেন। রবীন্দ্রনাথ খাতাটিতে তাৎক্ষণিক কিছু না লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন উত্তরায়ণে। পরদিন এসে খাতা নিয়ে যেতে বললেন। যথারীতি পরদিন সত্যজিৎ খাতা আনতে গেলেন। তখনও তিনি জানেন না কতবড় বিস্ময় তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে আছে। কবিগুরু সাত বছরের সত্যজিতের অটোগ্রাফের খাতায় একটি আট লাইনের কবিতা লিখে উপহার দিয়েছিলেন। কবিতাটি হল—

“বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।”

সেদিনের সেই বিস্মিত শিশু ওই কবিতাটির মর্মার্থ হয়তো বোঝেননি। তবে এতো বড় একজন মানুষ তাঁকে এতটা গুরুত্ব দিয়েছেন একথা আমৃত্যু মনে রেখেছিলেন তা বেশ বোঝা যায়। পরবর্তীতে তাঁর কাজের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রপ্রীতি সেকথাই বলে। এ যে তাঁর জীবনে অনন্য প্রাপ্তি তা তিনি পরবর্তী জীবনে অনুভব করেছেন। রবিঠাকুর শুধুমাত্র একখনা সই করেই খাতাখানি ফেরত দিতে পারতেন। তা তিনি দেনিনি। কারণ সত্যজিতের মা সুপ্রভা দেবীকে তিনি কন্যাসম স্নেহ করতেন। এমনও হতে পারে শিশু সত্যজিতের অবয়বে কবিগুরু এমন দ্যুতি দেখতে পেয়েছিলেন যে, তাঁকে ওই দুর্লভ উপহার দিতে কার্পণ্য করেননি। সেই থেকেই সত্যিজিৎ রায়ের রবীন্দ্রবন্ধন শুরু।

রবিঠাকুর আর সত্যজিৎ দুই বাঙালি মহিরূহ। দুজনই জন্মেছিলেন গ্রীষ্মের খরতাপের দিনে। কনিষ্ঠজন মে’র ৫ তারিখে আর জ্যেষ্ঠ মে’র ৭ তারিখে। দুজনই বাঙালি জাতিকে গর্বিত করেছেন। কবিগুরুর অনেক গুণাবলীই সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে বিদ্যমান। দূরদৃষ্টিতা, প্রখর মেধা, শাণিত কলম এবং দুজনেই চিত্রকর। সবচাইতে বেশি মিল যেখানে তা হচ্ছে দুজনই মানবতাবাদী যা তাঁরা তাঁদের কর্মে প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তাঁদের বয়সের ব্যবধান ছিল ৬০ বছর। ১৯৩৭ সালে সত্যজিৎ রায়ের মা তাঁকে ভর্তি করেছিলেন শান্তিনিকেতনে। উদ্দেশ্য রবীন্দ্র সাহচর্যে বেড়ে উঠবে তাঁর মানিক। তখন মানিকের বয়স ১৬ বছর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুকাল অবধি সত্যজিৎ রায় শান্তিনিকেতনেই ছিলেন। রবিঠাকুরের প্রয়াণের পর যেদিন জাপানীরা কলকাতায় বোমা ফেলেছিল সেদিন সত্যজিৎ রায় শান্তিনিকেতন ছেড়েছেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২০।

শৈশবে, কৈশোরে কিংবা তারুণ্যে সত্যজিৎ রায় যে কবিগুরুর প্রতি প্রবল আকর্ষণ বোধ করতেন তা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না। এ বিষয়ে সত্যিজিৎ রায় নিজেই বলেছেন, “তাঁর কাছে ভয় সম্ভ্রমে জড়োসড়ো হয়ে কোনওরকমে এগিয়ে গিয়ে তাঁর পা ছুঁয়েছি”। শান্তিনিকেতনে সত্যজিতের ভাল লাগতো কিন্তু কলকাতা যতটা টানতো ততটা নয়। তবে রবিঠাকুর কিন্তু চাইতেন সত্যজিৎ তাঁর সাহচর্যে থাকুক।

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, রবিঠাকুরের মৃত্যুর পর সত্যজিৎ কবিগুরুকে নিয়ে ভাবতে থাকেন। তাঁর ভেতর এক ধরণের ঘোরলাগা প্রেম জমতে থাকে গুরুদেবের প্রতি যা তিনি তাঁর কর্মে প্রকাশ করেছেন। রবি প্রয়াণের ৪ বছর পর তিনি সুধীর চন্দ্র করের ‘জনগণের রবীন্দ্রনাথ’ বইটির প্রচ্ছদ আঁকেন। এর বেশকিছু বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৫ সালে অমল হোমের ‘পুরুষত্তোম রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকে প্রশংসিত হন সত্যজিৎ।

রবীন্দ্র গবেষকদের মতে সত্যজিৎ রায়ের সেই ঘোরলাগা প্রেম ভক্তিতে রূপান্তরিত হয় আসলে ১৯৬১ সালে। সেই বছর সারা দেশজুড়ে ‘রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী’পালন শুরু হল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ব্যক্তিগত অনুরোধে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ৫৪ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে সেটি রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার অর্জন করে। এই তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় রবিঠাকুরকে জানতে চেষ্টা করেন। রবিসৃষ্ট বিশাল সমুদ্রে তিনি অবগাহন করেন। কবিগুরু যে আমাদের জীবনে সদা প্রাসঙ্গিক তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। এরপর সত্যজিৎ রায় তাঁর অধিকাংশ চলচ্চিত্রে রবিঠাকুরের গান ব্যবহার করেছেন। চলচিত্রায়নের জন্যে একের পর এক রবীন্দ্র গল্প বা উপন্যাস বেছে নিতে থাকেন। রবিঠাকুরের ছোট গল্প ‘সমাপ্তি’, ‘পোস্টমাস্টার’ এবং ‘মনিহারা’ নিয়ে তৈরি করেন ‘তিনকন্যা’ ছবিটি। ‘নষ্টনীড়’ গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্ররূপ দেন ‘চারুলতা’। যা কালজয়ী হিসেবে গণ্য হয়। ছবিটি রাষ্ট্রপতি পদকে ভূষিত হয়। এছাড়াও বার্লিন ও মেক্সিকো চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরষ্কৃত হয়। সত্যজিৎ রায় যেভাবে রবীন্দ্রচর্চা করেছেন, যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করেছেন তা আজকের প্রজন্মের কাছে অনুসরণীয় হতেই পারে।

এখনও ফি বছর গ্রীষ্ম আসে গ্রীষ্ম যায়। এপার বাংলায় ওপার বাংলায় রবীন্দ্র জয়ন্তী পালিত হয়। কিন্তু সেসব আয়োজনে প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায় না। কেমন যেন মেকি। কপিরাইটের সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ায় রবীন্দ্রনাথেরর গান নিয়ে সেচ্ছাচারিতা সত্যিকারের রবীন্দ্রপ্রেমীদের কষ্ট দেয় বৈকি। সব মিলিয়ে একটা অস্থির সময় যাচ্ছে। এতোকিছুর পরেও বাংলার আনাচে কানাচে কিছু মানুষ চেতনে অবচেতনে রবিঠাকুরের কাছে আশ্রয় নেয়। শান্তি খোঁজে। সান্ত্বনা পায়। তাঁদের সাধুবাদ জানাতে হয়। এমনিভাবেই শুধু বইয়ের সুদৃশ্য তাঁকে বা টিভি চ্যানেলে কিংবা পোশাকী আয়োজনে নয় কিছু মানুষের অন্তরে কবিগুরু চিরদিন বেঁচে থাকবেন। বৃষ্টি পরবর্তী আজকের অপেক্ষাকৃত এই শীতল দিনে বাংলার দুই দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সত্যজিৎ রায়কে গভীর প্রণতি জানাই।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতিকর্মী; আইনজীবী