কামানগুলো এমনভাবে সার-বেঁধে রাখা হয়েছে দেখে মনে হচ্ছে যেনো কোনো ডাইনি বুড়ির দাঁতের পাটি। জিব্রালটারের এক বিশাল পাহাড়ের মুখে রাখা এসব কামান দেখে এমনও মনে হচ্ছে যেনো একটা সিংহের মুখ। ভাবসাবে মনে হচ্ছে যেনো পশুদের রাজামশাই সিংহ বাবু এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বেন!
এখানে অপ্রতিরোধ্য আধিপত্য গড়ে তুলেছে ইংরেজরা। দখল করে নিয়ে তারা হয়েছে এখানকার প্রভু। আর স্পেনের মানুষদেরকে বানিয়েছে তাদের প্রজা। ইংরেজরা তাদের এই আধিপত্য ধরে রাখতে পেরেছে তার বড় কারণ হল এখানকার ভৌগলিক অবস্থান। জল কিংবা স্থল- কোনোদিক দিয়ে এসেই ইংরেজদের হটিয়ে জিব্রালটার পুনরুদ্ধার করা স্পেনিয়দের পক্ষে সম্ভব ছিল না বললেই চলে।
কিন্তু সেই পরাধীন স্পেনিয়দের ভেতরে ছিল এমন একজন যার বুকের গভীরে ছিল দেশপ্রেম আর স্বাধীনতা লাভের অদম্য ও তীব্র বাসনা। যেনো তার বুকে জ¦লছিল কোনো এক শিখা-চিরন্তন! ইংরেজ শাসনের শতকঠিন ভয়েও তা নেভানো যায় না। একটা অদ্ভুত দল গঠন করেছিল সে। সেই দলের প্রধান ছিল নিজেই। তার এবং তার দলের কাজকর্ম ও কথাবার্তা শুনে লোকেরা হাসাহাসি করতো। তাদেরকে মনে করতো বোধবুদ্ধিহীন খ্যাপাটে বাউন্ডেলের দল। তা না হলে মাত্র কয়েকজনের এই ছন্নছাড়ার দল কিনা প্রবল পরাক্রমশালী ইংরেজ বাহিনিকে দেশ থেকে হটিয়ে দেওয়ার চিন্তা করতে পারে!
তারপর একদিন হঠাৎ করেই মানুষটি কোথায় যে হারিয়ে গেল তার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। এভাবে চলে গেল দশ বছর। তবু সে ফিরে এল না। কেউ এতদিনেও তার কোনো হদিস পেল না। তখন সবাই ধরে নিল, মানুষটি হয়তো বেঁচে নেই আর।
মানুষটার নাম ছিল জিল ব্রাল্টার। লোকেরা তার হদিস না পেলেও সে কিন্তু কোথাও যায়নি। মরেও যায়নি। বরং ছিল সাতপুরুষের মাতৃভূমি তার প্রিয় জন্মভূমিতেই। তবে আদিম মানুষের মতো গুহাজীবন যাপন করতে শুরু করেছিল। ঘন বনজঙ্গল আর পাহাড়ের গুহায় দিন কাটাতো। সান মিগেল নামের একটি প্রাচীন গুহা ছিল। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নানা ঘুরপথে সমুদ্রে গিয়ে শেষ হয়েছে গুহাটি। সানি মিগেল ছিল জিলের সবচেয়ে পছন্দের আস্তানা।
এলাকার মানুষেরা যে মনে করে নিয়েছিল, জিল আর বেঁচে নেই, সে কথাও একরকম সত্যি বটে। কেননা মানুষের মতো জীবন সে ত্যাগ করে বেছে নিয়েছিল অন্যরকম এক বন্য জীবন। তাই এই জিলকে আর মানুষ না বলে পশু বলা যেতে পারে হয়তো।
প্রায় সাতশো জনের একটা দল। এর সদস্যরা আকৃতিতে ছোটখাটো, অনেকটা বেঁটে-ই বলা যেতে পারে। কিন্তু তারা বেশ সবল। আবার নমনীয়ও বটে। হাঁটুতে ভর দিয়ে এমন ক্ষীপ্র গতিতে লাফ দেয় যে দেখে তাক লেগে যায়!
এখানে এখন সূর্যাস্তের নরম আলো। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে যুথবদ্ধ একদল সেনানী। পশ্চিমে পর্বতমালার উপরে সূর্য ডুবছে ধীরে ধীরে। সূর্য যত পশ্চিমে চলেছে ক্রমশ গাঢ় অন্ধকার নেমে আসছে উপত্যকায়। উপত্যকার একদিকে সানোরে আর বোনডা পর্বতমালা। অন্যদিকে রুক্ষ কুয়েরেেভা পাহাড়।
কুয়েরভোর চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন তাদের নেতা। দূরের পাহাড়-চূড়াটির নাম গ্রেটরক। সেখানে সামিরক বাহিনির একটি ঘাঁটি আছে। সেখান থেকে ওরা সবসময় কড়া নজর রাখে এই এলাকার ওপর। শহরে ঢোকা ও বের হওয়ার একমাত্র পথ এটাই। তবে পথটা বেশ দুর্গম আর গোপনীয়। উপর থেকে পাহাড়ের তলায় বা নিচের দিকটাতে কী হচ্ছে তা নজরে পড়ে না কোনোভাবেই।
দলের নেতা দেখতে লম্বাটে। পরণে বানরের চামড়ার পোশাক। মাথায় উস্কোখুস্কো চুল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পায়ের গোড়ালিটা ভীষণ শক্ত, যেনো ঘোড়ার খুরের মতো। সব মিলিয়ে একটা সং বলে মনে হয় তাকে দেখলে।
পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সে তার দলের সদস্যদেরকে পাহাড়ের নিচের দিকে একটা খালের দিকে ইশারা করলো। সাথেসাথে দলের সবাই একইভাবে তাদের হাত বাড়িয়ে খালের দিকটায় ইশারা করলো। নেতা হাত নামিয়ে নেওয়ার সাথেসাথে তারাও হাত নামিয়ে নিল। নেতা মাটির দিকে খানিকটা ঝুঁকলো। দলের সদস্যরা একইভাবে ঝুঁকলো। এরপর নেতা তার হাতে থাকা লঠি শূন্যে তুলে নাড়ালো। দলের সবাই নিজেদের লাঠি শূন্যে তুলে ধরে নাড়াতে লাগলো।
এবার সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময়। আগের মতোই এবারও সবাই নেতার অনুসারী। নেতা যেনো তাদের পথপ্রদর্শক। সে পাহাড়ের উপর থেকে লাফ দিয়ে বুকে হেঁটে এগিয়ে যেতে থাকে গাছের তলা দিয়ে। দলের সবাই তাকে অনুকরণ করে এগুতে থাকে।
মিনিট দশেকের মধ্যে তারা পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে আসে চলাচলের পথে। তাদের এই কুচকাওয়াজ-রেওয়াজ এতটাই নিখুঁত ও সুশৃঙ্খল যে পাহাড়ের গা থেকে একটা ছোট পাথর খ-ও গড়িয়ে পড়লো না। সামান্য টু-শব্দটিও শোনা গেল না।
নেতা থেমে গেল, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মুহূর্তেই দলের সবাই এমন স্থির হয়ে থমকে দাঁড়ালো যে দেখে মনে হবে কেউ যেনো পাথরের মূর্তি তৈরি করে রেখেছে এখানে।
এখান থেকে প্রায় দু’শো গজ নিচে শহর। সেখানে লোকালয়ে মানুষের বসবাস। শহরে ছবির মতো করে গড়ে উঠেছে বাড়িঘর, বাংলো, ডাকঘর আর হাসপাতাল। শহরজুরে দীপাবলীর মতো আলো জ্বলছে। দূর থেকে দেখে মনে হয় যেনো আলোর মালা গেঁথে রাখা হয়েছে। তারথেকে আরেকটু দূরে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র তীরে দাঁড়িয়ে আছে যুদ্ধজাহাজ ও সওদাগরি জাহাজ। আরেকটু দূরে অয়রোপা অন্তরীপ। তার শেষ মাথায় সমুদ্রের বুকে কোণাকুণি হয়ে পড়েছে বাতিঘরের আলো। সবটা মিলে পরিপূর্ণ এক চমৎকার দৃশ্য যেনো।
রাতের নিস্তব্ধতার তছনছ করে হঠাৎ গর্জন করে উঠলো গুপ্ত গোলন্দাজ বাহিনির কামান। তারপরেই গুম গুম ঢাকের সাথে কান ফাটানো ঝাঝর বাজানোর শব্দ বাজলো কিছুক্ষণ।
এটা প্রতি রাতের নিয়মিত সংকেত। এই সংকেতের পরে অপ্রয়োজনে আর ঘরের বাইরে থাকার অনুমতি নেই। একটু পরেই শহরে সেপাইদের টহল শুরু হবে। কোনো লোককে পথে পেলেই তাকে ধরে শুরু হবে জিজ্ঞাসাবাদ। বাইরে থাকার সন্তোষজনক কারণ বলতে না পারলে তাকে ধরে আটক করে পাঠিয়ে দেওয়া হবে কারাগারে।
মনে হচ্ছে আজ শহরের কোথাও কোনোরকম গোলমাল নেই। চারিদিক নিশ্চুপ, শুনশান নীরবতা। এখানকার সবকিছুর দেখভালের হর্তকর্তা জেনারেল ম্যাকাকলেম তার কোয়ার্টারে নিশ্চিন্ত একটি রাত কাটানোর ভাবনায় ডুব দিচ্ছিলেন। কেননা জিব্রলটারের কোথাও কোনো অশান্তি বা বিপদআপদের ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
কিন্তু বিধিবাম। জেনারেলের ভাগ্যে নিশ্চিন্ত ঘুম যে এই রাতে লেখা নেই।
জেনারেল ম্যাকাকলেম দেখতে গড়পড়তা নয়। দেখলে ভুলে যাওয়ার মতো নয়। বরং তার চেহারাখানা বিশেষভাবে নজরে পড়বার মতো। হাত দুটি অস্বাভাবিক লম্বা। লোমশ ঘন ভুরুযুগল। তার নিচে টিমটিমে একজোড়া চোখ। থুতনিতে একটুখানি দাড়ি। কথা বলার সময় মুখের ভঙ্গী যেমন কিম্ভুতরকম হয়ে যায়, সেই সাথে হাত-পাগুলোও নড়তে থাকে অনবরত। এরকম উদ্ভট কদাকার চেহারায় কোনো ইংরেজ জেনারেলকে ঠিক মানায় না। বরং বানর থেকে মানুষ এসেছে বলে যে ধারণা সেটা যেনো এই জেনারেলকে একবার দেখলেই সত্যি বলে মনে হয়। তবে হ্যাঁ, চেহারায় বানরের মতো হলেও যুদ্ধবিদ্যায় সে অতুলনীয়। ভীষণ চৌকশ ও বুদ্ধিদীপ্ত জেনারেলের চেহারার ঘাটতি যেনো ঈশ^র তার এসব গুণ দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছেন।
এদিন রাতে ম্যাকাকলেম যখন কেবল সুখের ঘুমে বিভোর হয়েছেন, হঠাৎই তার ঘরের দরজা ধাক্কা দিয়ে প্রায় লাফিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো তার বেয়ারা। চিৎকার করে ডাকলো, “হুজুর”!
দরজা খোলার বিকট শব্দ পেয়েই ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসেছিলেন জেনারেল। চিৎকার করে ধমকের স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “কী? কী হয়েছে?”
– শহর আক্রান্ত হয়েছে হুজুর। উত্তেজিত কিন্তু চাপা কণ্ঠে বললেন বেয়ারা-কাম-এডিকংয়ের।
– কারা? এত বড় দুঃসাহস কাদের?
– স্পেনের অধিবাসী বলেই মনে হচ্ছে।
লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নিচে নামতে নামতে জেনারেল শুনতে পেলেন বাইরে প্রচণ্ড হট্টগোল। নিজের সৈনিকের পোশাক পরতে পরতে জিজ্ঞেস করলেন, এত চেঁচামেচি কিসের?
– পাথর পড়ছে হুজুর। পাহাড়ের উপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ছে। সারা শহরের উপর বৃষ্টির মতো পাথর পড়ছে।
– হুম্। মাথায় হেলমেট পরতে পরতে গম্ভীর মুখ করে জেনারেল বললেন, ‘অনেক লোক জুটিয়েছে ওরা। সব মাতাল, জোচ্চোর আর ভবঘরেদের একত্রিত করে হামলা করেছে। যাই হোক, গভর্নরকে খবর দেওয়া হয়েছে?
– সম্ভব না হুজুর। এই অবস্থায় অয়রোপা অন্তরীপে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। সবগুলো পথ শত্রুদের দখলে। রাস্তা শত্রুসেনায় ভরা।
ঘটনাটা আকস্মিক ঘটে যাওয়ায় ইংরেজ সেনাদল ভীষণ বেকায়দায় পড়ে গিয়েছে। জেনারেলের বিশ্রী চেহারা যেনো এই পরিস্থিতিতে পড়ে আরও বিকট দেখাচ্ছে।
– আর ওয়াটার পোর্টের শিবির? সেটার কী খবর? কোমরে বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে জিজ্ঞেস করেন জেনারেল।
– সেখানকার অবস্থাও খারাপ। গোলন্দাজদের সবাইকে বন্দি করে রেখেছে শিবিরে।
– হুম্। তোমার সাথে কতজন লোক আছে?
– জনা বিশেক হুজুর।
– তা বলে কি হার মানতে হবে? বিড়বিড় করে এসব বলতে বলতে খ্যাক খ্যাক করে চিৎকার করে ওঠেন জেনারেল ম্যাকাকলেম, ‘না, কখনোই না। কতগুলো হাড়হাভাতের কাছে ইংল্যান্ডের পরাজয় কখনোই হতে পারে না। না-’
ঠিক তখনই ঘরের দরজা ভেঙে লাফিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে এক আজব প্রাণী! আকারআকৃতিতে যেমন অদ্ভুত তেমনি তার চালচলনও উদ্ভট। সে হুট করে জেনারেলের কাঁধের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্র পশুর মতো গর্জন তুলে হুংকার দেয়, এখনই আত্মসমর্পণ করো।
ঘটনার আকস্মিকতায় জেনারেল এতটাই বেশামাল হয়ে পড়েন যে কিছু বলবার ভাষা হারিয়ে ফেলেন। এডিকংয়ের পেছনে থাকা ম্যাকাকমেলের সেনাসদস্যরা বাতির আলোয় আগন্তুককে চিনতে পেরে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে।
– জিল ব্রাল্টার! ও কোথা থেকে এল?
হ্যাঁ সে-ই। সান মিগেলের গুহার সেই জঙ্গলিটাই বানরের সাজ নিয়ে এসেছে। বছরের পর বছর আত্মগোপনে থেকে নিজের দল তৈরি করে আজ এই আক্রমণ করেছে। আর তার ফলেই ইংরেজ জেনারেলের এখন যা-তা অবস্থা।
ওদের হতচকিতভাব কাটার আগেই জিল আবার ধমকে জিজ্ঞেস করলো, করবে আত্মসমর্পণ?
– না, কখনই না। সদম্ভে উত্তর দেন নির্ভিক ইংরেজ জেনারেল।
জেনারেলের ইশারা বুঝতে পেরে সাথেসাথেই তার যে কয়জন সেনাসদস্য ঘরের ভেতর ছিল তারা জিল ব্রাল্টারকে ঘিরে ফেলে। অবস্থা খারাপ বুঝতে পেরে জিল শিস্ বাজায়। তীক্ষ্ণ এবং দীর্ঘলয়ে শিস্ বাজাতে থাকে। আর অমনি বানর আসতে থাকে জেনারেলের কোয়ার্টারে।
ইংরেজরা এসে দখল নেওয়ার আগে এই পাহাড়ের মালিক ছিল এই বানরেরাই। তারা স্বাধীনভাবে পাহাড়ের চূড়া ও উপত্যকার যেখানে খুশি মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতো। তখনও স্পেনের মানুষেরা এখানে আসেনি। ক্রমওয়েল পাহাড়টা দখলের কথা স্বপ্নেও ভাবেননি। তখন বানরেরাই ছিল এই এলাকার আদিম বাসিন্দ। এখানকার আকাশ, মুক্তবাতাস, মাটি আর পাথরের সাথে তাদের অনাদিকালের বন্ধুত্ব।
এই ক্ষীপ্র ও দুর্ধর্ষ বানরদের নিয়েই জিল ব্রাল্টার গড়ে তুলেছে তার সেনাবাহিনি! ওদেরকে আঘাত করার সাহস এখানে কারও নেই। কেননা, এখানকার সকলেই জানে যে ওদের কোনো একজনের গায়ে টোকা দিলেও ওরা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিশোধ নেয় অদ্ভুত নিষ্ঠুরভাবে। একের পর এক পাথর গড়িয়ে ওরা নিশ্চিহ্ন করে দেয় আঘাতকারীসহ আশেপাশের সবাইকে।
আজ এই বানরদলের নেতার ভূমিকায় রয়েছে জিল। সেই জিল ব্রাল্টার যার অদ্ভুত বাউন্ডেলেপনা জীবনের জন্য এলাকার মানুষেরা যাকে বানর বলেই ডাকতো। কিন্তু জিলের মাথায় সারাজীবন কেবল একটা চিন্তাই ছিল- কী করে ইংরেজদের তারিয়ে প্রিয় মাতৃভূমি স্পেনকে শত্রুমুক্ত করা যায়। ইংরেজরা আক্রমণকারী দখলবাজ। ওদের উচ্ছেদ করে জন্মভূমিকে স্বাধীন করতেই হবে- এই প্রতিজ্ঞায় সে ছিল অবিচল।
আজ যদি এই বানরদলের কাছে হেরে গিয়ে ইংরেজদের চলে যেতে হয় তা হবে ইংরেজ ইতিহাসের কলঙ্কজনক লজ্জার ঘটনা। যে ইংরেজ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনও অস্ত যায় না, যারা জয় করেছে ভারতবর্ষ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকাসহ ছোট-বড় আরও কত দেশ- তাদের কিনা হার মানতে হবে একদল বানরসেনার কাছে!
জেনারেল ম্যাকাকমেলের মতো দাম্ভিক সেনাপ্রধানের পক্ষে এ লজ্জা মেনে নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। এই অপমান তিনি সহ্য করতে পারবেন না। তারচেয়ে বরং নিজের রিভলভারের গুলিতে নিজের মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়ে আত্মাহূতি দেওয়াই হবে তার জন্য সম্মানের। প্রয়োজনে সেই পথই বেছে নিবেন বলে মনে মনে ভাবতে থাকেন জেনারেল।
জিল ব্রাল্টারের শিস্ শুনে বানরদল ঘরে ঢোকার আগেই জেনারেলের কয়েকজন সেনা জিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে চেপে ধরেছিল। জিলের গায়ে যতই পাগলা হাতির মতো শক্তি থাকুক, এতজন প্রশিক্ষিত ইংরেজ সেনার সাথে সে পেরে ওঠেনি। তাকে টেনে-হিঁচড়ে তার গা থেকে বানরের পোশাকটা খুলে নিয়ে তাকে প্রায় উলঙ্গ করে ঘরের এক কোণে তাকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখে ওরা। মুখে পুড়ে দেয় কাপড়েরর দলা। একটু পরে জেনারেল বাইরে বেরুলেন পরিস্থিতি দেখার জন্য।
বাইরে তখন যুদ্ধাবস্থা। ইংরেজ সেনারা ওয়াটার পোর্ট প্রবেশদ্বারের কাছে এক দফা লড়াই করে পরিস্থিতি কোনোরকমে সামাল দিয়ে জেনারেলের কোয়ার্টারের দিকে ছুটে আসে। কিন্তু বানরেরা সংখ্যায় অগণিত। প্রাণপণ লড়াই করে চলেছে তারা ইংরেজদের সাথে। এ যেনো তাদেরও মাতৃভূমি পুনরুদ্ধারের লড়াই। জিব্রাল্টারের দুর্ভেদ্য দুর্গ আজ হয়তো বানরেরা দখল করেই নিবে। বাধ্য হয়ে ইংরেজ সেনারা পিছু হটবার চিন্তা করতে শুরু করেছে। তাদের ভেতর এই ভয়ও ঢুকে গেছে, এখন যদি স্পেনবাসী বানরদরে সাথে যোগ দেয় তাহলে পালানোর সময়ও পাওয়া যাবে না আর। কেল্লা, ছাউনি, সেনা-ব্যারাক সব শূন্য হতে সময় লাগবে না মোটেও।
কিন্তু এমন অবস্থা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না জেনারেল ম্যাকাকলেম। পিছু হটা বা পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না তিনি।
মশাল জ্বলে উঠলো। তার আলোয় দেখা গেল এক অবাককর ঘটনা। এতক্ষণ প্রাণপণ লড়াই করে যে বানরদল ইংরেজদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল তারা হঠাৎ পিছু হটলে। সবার সামনে চলেছে বানরসেনাদলের নেতা। সে তাদের লাঠি উঁচু করে কুচকাওয়াজ করাতে করাতে নিয়ে চলেছে। তার পেছন পেছন তাকে অনুসরণ করে চলেছে ঝাঁকে ঝাঁকে বানর।
জিল ব্রাল্টার তো বন্দি ছিল জেনারেলের কোয়ার্টারে। সে কী করে বের হয়ে এল? হয়তো দাঁত দিয়ে কামড়ে দড়ি কেটে বেরিয়ে পড়েছে। ওর যা শক্তি আর জেদ, তাতে কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু হঠাৎ কোথায় চলেছে সে তার দলবল নিয়ে?
অয়রোপা অন্তরীপের দিকে যাবে? গভর্নরের বাড়ি আক্রমণ করবে? তাকে বন্দি করে বলবে আত্মসমর্পণ করতে?
কিন্তু এ কী! ওরা যে শহর ছেড়েই চলে যাচ্ছে। আলামেদা প্রবেশদ্বার পেরিয়ে নেতা এগিয়ে চলল পাহাড়ের ঢালের দিকের আঁকাবাঁকা পথে। পেছনে পেছনে চলছে তার অনুগত বানর সেনাদল।
ঘন্টাখানেক পরে জিব্রালটারে আর কোনো আক্রমণকারীকে দেখা গেল না।
কী এমন ঘটে গেল?
ঘটনার অস্পষ্টতা কাটতে একটু সময় লাগলো। জেনারেল ম্যাকাকলেম এলেন পার্কে। তার কাছ থেকেই জানা গেল আসল কাহিনি।
পিছু-হটা বানর সেনাদলেন পাগলাটে নেতার ভূমিকা নিয়েছিলেন স্বয়ং ম্যাকাকলেম। ছলে-বলে-কৌশলে হলেও শত্রুকে পরাজিত করাই ইংরেজদের নীতি। সেই নীতির পূর্ণ ব্যবহার আজ করেছেন এই চতুর জেনারেল। জিলের পরনের পোশাক নিজে পরে নিখুঁত ছদ্মবেশ নিয়ে বানর সেনাদলকে শহর-ছাড়া করেছেন। আর তার চেহারাও বানরের মতো বলেই সহজেই ফাঁদে ফেলতে পেরেছেন বানরদেরকে। তারপরের ঘটনা এবং চতুরতায় ইংরেজ জেনারেলের দক্ষতা তো মশালের আলোয় সকলেই দেখেছে।
চৌকস সেনাপ্রধানের মাথায় চট করে এই দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়। এরকম তীক্ষè বুদ্ধিমত্তা, রাজভক্তি আর সাহসের জন্যই সেন্ট জর্জের ক্রশ সম্মাননাও জোটে তার ভাগ্যে।
জিল ব্রাল্টারকে কী করা হয়েছিল? ইংরেজরা তাকে চড়া দামে বিক্রি করে দিল এক সার্কাস দলের কাছে। ইয়োরোপ আমেরিকার নানা শহরে সে এখন খেলা দেখিয়ে দেখিয়ে বেড়ায়, বানর-খেলা। দর্শক আকর্ষণের জন্য সার্কাস দলের মালিক প্রচার করে যে, এ সান মিগেলের সেই জঙ্গলি জিল ব্রাল্টার নয়, বরং এই হচ্ছে আসল জেনারেল ম্যাকাকলেম।
কিন্তু বানর সেনাদলের আক্রমণ ইংরেজ সরকারের টনক নড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার পর ইংরেজ সরকার এক আজব সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ঠিক করে, এখন থেকে জিব্রালটারের সেনা প্রধান হিসেবে সবসময়ই পাঠানো হবে তাদের সবচেয়ে কুৎসিত-কদাকার চেহারার জেনারেলকে। তাহলে হয়তো প্রয়োজনে আবারও সুশৃঙ্খল বানরসেনাদলকে ফাঁদে ফেলা যাবে। কেননা, জিব্রালটার এমন এক জায়গা যেখানে মানুষদের দখলদারীত্ব টিকে থাকবে বানরদের দয়ার উপর নির্ভর করেই। তাদের সাথে লড়াইয়ে পেরে উঠতে হলে কেবল যুদ্ধকৌশল আর বুদ্ধিমত্তাই যথেষ্ট নয়, বরং দরকার চেহারায়ও ওদের সাথে মিল থাকা।
২.
মাজহারুল হক মন্টু। যশোরের ছাত্র রাজনীতির অঙ্গনে একটা পরিচিত নাম। স্নাতক শেষবর্ষের ছাত্র। স্কুলজীবন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ১৯৬৯ সালের স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে তার রয়েছে অনন্য সাধারণ ভূমিকা। তাছাড়াও ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে সক্রিয় প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে দলের ভেতরে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে তুলেছেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের পর ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আওয়ামী লীগের নানা টানাপোড়েন শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পূর্বে আহুত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর সারা বাংলাদেশের মতো যশোর শহরেও প্রবল গণআন্দোলন শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় যশোর শহরের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে এসে আন্দোলন শুরু করে। ৩ মার্চ ছাত্র-জনতার একটা মিছিল যশোর কালেক্টর ভবনে উড্ডীন পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা নামিয়ে একটা কালো পতাকা উত্তোলন করে যখন ফিরে আসছিল, তখন টিএন্ডটি ভবন থেকে পাকিস্তানি সেনারা গুলি বর্ষণ করলে চারুবালা নামে একজন গৃহবধূ নিহত হন। যার ফলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে থেকে বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে সারা বাংলাদেশের মতো যশোরেও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। তখন প্রতিদিনই শহরে চলতে থাকে প্রতিবাদ মিছিল, মিটিং।
২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে ছাত্রনেতা খান টিপু সুলতানের নেতৃত্বে যশোর শহরের নিয়াজ পার্কে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৫ মার্চের রাতের আঁধারে হানাদার খান সেনারা যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরে প্রবেশ করে রাস্তায় অবস্থানরত জনতার উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে অনেক সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। অন্যদিকে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই সারাদেশে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মাযহারুল হক মন্টু একজন ছাত্রনেতা হিসাবে যশোর শহরের আন্দোলনের প্রতিটা স্তরে যথাযথ ভূমিকা রাখার পাশাপশি শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু সাধারণ ৩০৩ রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করে আধৃুুনিক অস্ত্র সজ্জিত শত্রুসেনাদের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত হয়ে তার নেতৃত্বে একটা গেরিলা দল নিয়ে গত ৭ দিন আগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যশোর সদর থানার প্রত্যন্ত এলাকা কাশিমপুর গ্রামে সেল্টার গ্রহণ করেন। তিনি কলেজ পড়ুয়া একজন যুবক হলেও তাকে দেখে মনে হয় যেন একজন আর্মি অফিসার। কথাবার্তায় চালচলনে যেন আভিজাত্য ঝরে পড়ে। সামরিক বাহিনীতে সৈনিকদের যেমন কড়া আইন কানুনের মধ্যে থাকতে হয়, তেমনি তার অধীনের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের থাকতে হয় কঠোর আইন কানুনের মধ্যে। পান থেকে চুন খসলেই কারো রেহাই নেই। সেন্টি ডিউটি বা রেকি করা কোন কাজেই সামান্যতম অবহেলাও তার সহ্য হয় না।
সেই কড়া স্বভাবের মাজহারুল হক মন্টুকে আজ কিন্তু খুব প্রাণখোলা এবং খোশমেজাজে দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে অবশ্য একটা বড় কারণ আছে । তাহলো তার নেতৃত্বে আরও কয়েকটি গেরিলা দল মিলে আজ ভোর রাতে যশোর শহরের পূর্বের খাজুরা হাই স্কুল রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে বেশ কিছু রাজাকারকে হত্যা করে সফলতা দেখিয়েছে। অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের এই সফলতার পেছনে মোঃ ইসহাক নামের একজন সামরিক প্রশিক্ষপ্রাপ্ত মুজাহিদ সদস্যের অবদান সবচেয়ে বেশি। মুক্তিযোদ্ধা দলের সদস্য না হয়েও সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং খাজুরা রাজাকার ক্যাম্পের পাশের লেবুতলার গ্রামে বাড়ি হওয়ায় ক্যাম্পটির সেন্টি পোস্ট ও অন্যান্য অবস্থান সম্বন্ধে তার স্পষ্ট ধারণা ছিল। সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হওয়ায় যশোর অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে ইসহাক ইপিআর বাহিনীর সাথে প্রথম পর্যায়ের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সেই যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর প্রতিরোধ যোদ্ধারা ভারতে চলে গেলেও নতুন বিবাহিত স্ত্রী এবং পরিবারের অসুবিধার কথা ভেবে সে ভারতে যাওয়া থেকে বিরত ছিল। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করার পর সে আর ঘরে বসে থাকতে পারেনি। মাজহারুল হক মন্টুর গেরিলা দলটি কাশিমপুর গ্রামে সেল্টার গ্রহণ করার পর থেকেই সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে মন্টু সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে। তারর যোগ্যতা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার প্রচণ্ড আগ্রহ দেখে মন্টু সাহেব তাকে নিজ দলে অন্তভূক্ত করে নেন।
কাশিমপুর গ্রামে সেল্টার গ্রহণ করার পর থেকেই খাজুরা হাই স্কুল রাজাকার ক্যাম্পের নানা অপকর্মের কথা মন্টু সাহেবের কানে আসছিল। মাত্র ১০/১২ দিনের মধ্যে ২টি বাড়ি লুট এবং বেশ কয়েকজন নারীর সম্ভ্রমহানীর সাথে তাদের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় অন্যান্য গেরিলা কমান্ডারের সাথে আলোচনা করে মন্টু সাহেব খাজুরা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর একই এলাকায় বাড়ি, অবাধ যাতায়াতের সুযোগ এবং সামরিক বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হওয়ায় ক্যাম্পটি সরেজমিনে রেকি করে একটা খসড়া আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়ণের জন্য তিনি ইসহাককে দায়িত্ব প্রদান করেন। সেও সুযোগটি মনেপ্রাণে গ্রহণ করে। তারপর অবাধ যাতায়াতের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটা নিখুঁত আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সে তা মন্টু সাহেবের নিকট জমা দেয়। সেই আক্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে ৫ জন গেরিলা কমান্ডার আলোচনা করে সামান্য কিছু কাটছাট করে চুড়ান্ত করা হয়। তারপর মাযহারুল হক মন্টুর নেত্বত্বে ৫টা গেরিলা দলের ৫৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আজ ভোর তারা রাতে খাজুরা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে শতভাগ সফলতা লাভ করে। শুধু যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়নে সহযোগিতা নয়, ইসহাক অস্ত্র হাতে সরাসরি গুলিতে শত্রুর ২ জন সেন্টিকে হত্যা করে যুদ্ধ জয়ে অনেক ভূমিকা রেখেছে। তাইতো আজ সারাদিন ক্যাম্পে একটা আনন্দের আমেজ লেগে আছে। সাথে সাথে চলছে ইসহাক বন্দনা।
চলবে…
১৯৭১ সালের জুন মাসের শেষ দিক। বাংলাদেশে তখন চলছে পাকিস্তানি কসাই সেনাদের রক্তের হলিখেলা। ২৫শে মার্চের কাল রাত থেকে তারা সারা বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের উপর আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যার পাশাপাশি গ্রামের পর গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী ধর্ষণসহ নানা পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে মেতে উঠেছে। অন্য দিকে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা– ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ দেওয়ার পর থেকেই দেশে শুরু হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই সারা বাংলাদেশে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ যুদ্ধ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ই এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ এবং তার অল্প কিছু দিনের মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যগাথা শুনে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ যেমন উৎফুল্ল হয়ে উঠতো, তেমনি বাঙালি যুবকেরা মুুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে অনুপ্রেরণা খুঁজে পেত। যার ফলে দেশের ভেতর থেকে যুবক ছেলেরা দলে দলে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে শুরু করে।
দিনে দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে পাকি সেনারাও নতুন ফন্দি আঁটে। নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য স্বাধীনতাবিরোধী জামাতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামসহ অন্যান্য স্বাধীনতা বিরোধী দলের সহযোগিতায় তারা রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী গঠন-কাজে হাত দেয়। জুন মাসের প্রথম দিকে তাদের এই বাহিনী গঠন-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এই মাসের মাঝের দিকে জামাত নেতা লেবুতলা গ্রামের ইব্রাহিম ডাক্তারের নেতৃত্বে (হাতুরে ডাক্তার) যশোর শহর থেকে ২০ মাইল পূর্বে খাজুরা উচ্চ বিদ্যালয়ে একটা রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করার পর থেকেই তারা গ্রামের সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার, নির্যাতন, বাড়িঘর লুটপাট এবং নারী ধর্ষণের মতো গর্হিত কাজ শুরু করে দেয়। শুধু তাই না মাত্র ১০/১২ দিনের মধ্যেই লেবুতলা গ্রামের নিমাই কাপালি, গৌর মাষ্টারের বাড়িতে লুটপাট ও খাজুরার আলিয়র রহমানের স্ত্রী ও ২ বোনকে ধরে নিয়ে গিয়ে সম্ভ্রমহানী করার পর তারা এলাকায় মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়ে গেছে। এখন গাঁয়ের মানুষদের জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘের মতো অবস্থা। প্রতি রাতেই যেমন পাকিস্তানি কসাই সেনারা বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ চালাচ্ছে, তেমনি দিনের বেলায় রাজাকার ও আল বদরেরা গ্রামে গ্রামে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও নানা অসামাজিক কাজে মেতে উঠছে। শত্রুদের এই দ্বিমুখী আক্রমণে আজ বাংলাদেশের প্রতিটা এলাকায় নরকের যন্ত্রণা নেমে এসেছে। তাদের জীবন ও জীবিকা এলোমেলো হয়ে গেছে।
খান সেনাদের আক্রমণের আগাম খবর জানার জন্য এখন মানুষ তাদের রাতের ঘুমকে হারাম করে গাঁয়ে গাঁয়ে সারা রাত পাহারা বসিয়েছে। নির্ঘুম রাত কাটানোর পর দিনের বেলায় যে একটু শান্তিতে ঘুমাবে তারও কোন উপায় নেই। কারণ কখন যে রাজাকার আল বদরেরা হামলা করে বাড়ি ঘরে লুটপাট কিংবা যুবতি নারীদের অপহরণ করে নিয়ে যায় সেই চিন্তায় তাদের উৎকন্ঠিত থাকতে হয়। দিনের আলোয় তবুও মনে একটু বল পাওয়া যায়। কিন্তু রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে মানুষের জীবনও যেন ঘোর অন্ধকারে ছেয়ে যায়। তখন তাদের মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খায়– পরিবারের সবার জীবন রক্ষা করতে পারবো তো? বাড়ির যুবতি মা, বোন, কন্যার সম্ভ্রম রক্ষা করা যাবে তো? রাত যত গভীর হতে থাকে মানুষের মনের আতঙ্কও ততো বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরই মধ্যে এলাকায় জোর গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতরে প্রবেশ করেছে। কেউ তাদের চোখে দেখেনি। তবুও এই খবর শুনে সাধারণ মানুষ আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছে। এবার নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা তথা রাজাকার আলবদর বাহিনী পরাজিত হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। কিন্তু সেই স্বাধীনতার জন্য আর কত দিন আর কত রাত তাদের এমন দুঃসহ যাতনা ভোগ করতে হবে?
আজ ৩০শে জুন। জুন মাসের শেষ দিন। মানুষ জন সারা রাত গাঁ পাহারা দিয়ে ঘরে ফেরা শুরু করেছে। মসজিদে মসজিদে মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। ঠিক এমন সময় খাজুরিয়া রাজাকার ক্যাম্পের উপর যেন গুলির বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। এলএমজি, এসএলআর, ৩০৩ রাইফেলের গুলি ও গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দের পাশাপাশি মুর্হুমুহু ভেসে আসছে জয় বাংলা স্লোগান। তখন এলাকার মানুষের মনের সব সংশয় দূর হয়ে যায়। তারা নিশ্চিত হয়ে যায়, নরাধম রাজাকাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে মুক্তিযোদ্ধারাই খাজুরা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেছে। সারা ক্যাম্প এলাকায় যেন ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। সেই ভূমিকম্প যেন থামতেই চায় না। প্রায় ঘন্টা খানেক প্রবল গুলাগুলি চলার পর আস্তে আস্তে তা স্তিমিত হয়ে আসে। এরই মধ্যে পূর্ব আকাশে নতুন দিনের আশার সূর্য উদিত হতে দেখা যায়। দিনের আলোয় আশে পাশের বাড়িঘরের লোকজন ক্যাম্পের সামনে এসে দেখতে পায় ৫ জন রাজাকার মরে পড়ে আছে। বাকিরা জীবন বাঁচাতে ক্যাম্পের পিছনের ডোবায় আশ্রয় নিয়েছিল। মুক্তিবাহিনী চলে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে তারা ক্যাম্পে ফিরে আসছে। নরাধমদের এমন উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে দেখে গাঁয়ের লোকজন মনে মনে ভীষণ খুশি হলেও তারা মুখে তা প্রকাশ করতে পারে না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেদিনের রাতের খবরে যশোর জেলার খাজুরা রাজাকার ক্যাম্পের উপর মুক্তিযোদ্ধাদের সফল অপারেশন পরিচালনার খবর ফলাও করে প্রচার করার সাথে সাথে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বময়। এই খবর পেয়ে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিটা মুক্তিপাগল বাঙালির মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেদিনের চরমপত্র অনুষ্ঠানে শোনা গেল– বিচ্ছুদের গাবুড় মাইরের চোটে যশোরের খাজুরায় ৫ জন রাজাকার অক্কা পেয়েছে। বাকিরা জীবন বাঁচাতে ক্যাম্পের পেছনের ডোবার ভেতরে হাবুডুবু খেয়েছে।