অযোধ্যা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ধন্নীপুর গ্রাম। গত কয়েক বছর ধরে এই গ্রাম নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কারণ সরকার এখানে মুসলমানদের জন্য একটা মসজিদ গড়ার জন্য জমি দিয়েছে।
আজকের দিনেই ১৯৯২ সালে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। সেই জমিতে রামমন্দির নির্মাণ আর তার বদলে অন্য একটি জমি মসজিদ নির্মাণের জন্য দেওয়ার আদেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট।
অযোধ্যার বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমি রামমন্দিরের জন্য ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে ধন্নীপুর গ্রামে মুসলমানদের জন্য পাঁচ একর জমি দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের ২০১৯ সালের সেই রায়ের পরেই খুব দ্রুত গতিতে যখন রামমন্দির গড়ে উঠেছে, তার উদ্বোধন ও নিয়মিত পুজোও চলছে, অন্যদিকে ধন্নীপুরে মুসলমানদের মসজিদ নির্মাণ এখনও শুরুই হয়নি।
কোথায় ধন্নীপুর?
উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর-অযোধ্যা-লক্ষ্ণৌ মহাসড়কে রৌনাহি থানার পাশ থেকেই শুরু হয় ধন্নীপুর গ্রাম। যে জমিটা মসজিদ নির্মাণের জন্য দেওয়া হয়েছে, সেটা মহাসড়ক থেকে ২০০ মিটার দূরে।
সেখানে পৌঁছিয়ে দেখা গেল যে জমিতে টেন্ট ভাড়া দেন যারা, সেরকম কয়েকজন অনুষ্ঠান-বাড়ির শামিয়ানা শুকোতে দিয়েছেন। কৃষকরা তাদের গবাদি পশু চড়াচ্ছেন আর মাঠের মাঝখানে একটা দরগাহ নজরে এল।
জমি হাতে পাওয়ার প্রায় চার বছর পরেও কোথাও কোনও নির্মাণ কাজ চোখে পড়ল না। শুধু কয়েকটি জায়গায় সাইনবোর্ড লাগানো রয়েছে।
অন্যদিকে অযোধ্যার রাম মন্দিরে ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠার’ পরে যে নির্মাণ কাজ বাকি ছিল, তাও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। রাম মন্দির নির্মাণে প্রায় ১৮শো কোটি ভারতীয় টাকা খরচ হচ্ছে। মন্দিরে পৌঁছনর জন্য রাম-পথ গড়া হয়ে গেছে, সরকারের তরফে অযোধ্যাকে সাজিয়ে তোলার কাজও চলছে – তার জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দ হয়েছে।
অত্যাধুনিক নতুন বিমানবন্দর, বাস স্টেশন, রেল স্টেশন গড়া হয়েছে। অযোধ্যার উন্নয়নের জন্য এবছর কেন্দ্রীয় বাজেটে ১০০ কোটি ভারতীয় টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে আর আলাদাভাবে বিমানবন্দরের জন্য ১৫০ কোটি ভারতীয় টাকা দেওয়া হয়েছে।
দুই ধর্মের দুই উপাসনা-স্থলের ফারাকটা খুব চোখে পড়ছে।
মসজিদ নির্মাণের জন্য যে ট্রাস্ট গঠিত হয়েছে, তার সচিব আতাহার হুসেন বলছিলেন,”দুটোর মধ্যে তুলনা চলে না। রাম মন্দিরের জন্য নির্মাণ কাজ – পাথর খোদাই ইত্যাদি তো দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল। এছাড়াও রাম মন্দির গড়ে তুলতে সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল।”
এত দূরে কে নামাজ পড়তে আসবে!
ধন্নীপুর গ্রামের মানুষজন মসজিদের ব্যাপারে মুখ খুলতে চাইলেন না।
তবে একজন, মুহাম্মদ ইসলাম বলছিলেন,” মসজিদের জন্য অনেকবার দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে। কিন্তু কাজ তো কিছু্ শুরু হয় নি।
“আগে কমিটির সদস্যরা আসতেন ১৫ই আগস্ট আর ২৬শে জানুয়ারি জাতীয় পতাকা তুলতে তবে এ বছর তারা কেউ আসেননি। আমরা গ্রামের লোকেরাই পতাকা তুলেছি,” জানালেন মি. ইসলাম।
তিনি এও বলছিলেন যে যদি এখানে হাসপাতাল গড়া হত তাহলে এলাকার মানুষের লাভ হত। প্রায় চার থেকে ছয় ঘণ্টা যাত্রা করে লক্ষ্ণৌ যেতে হত না।
অল ইন্ডিয়া মিল্লি কাউন্সিলের মহাসচিব খালেক আহমদ খান বলছিলেন, “জমিটা দেওয়া হয়েছিল সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াক্ফ বোর্ডকে। তাদের দায়িত্ব ছিল নির্মাণ কাজ শুরু করা। যদি বাবরি মসজিদ মামলার মুসলমান পক্ষকে অথবা স্থানীয় মানুষকে দেওয়া হত তাহলে এতদিনে মসজিদ তৈরি হয়ে যেত।
“মসজিদ গড়ার কথা ছিল যারা বাবরি মসজিদে নামাজ পড়তেন, তাদের জন্য। এতদূরে কে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে আসবে!” বলছিলেন মি. খান।
বাবরি মসজিদ মামলার অন্যতম পক্ষ ইকবাল আনসারি এবছরের গোড়ার দিকে মসজিদের কাজ শুরু না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন, “ওয়াক্ফ বোর্ড জমিটা নিয়ে নিল। তবে কাজ শুরু করার কোনও পদক্ষেপই নেয় নি তারা। যতদিন মসজিদ অযোধ্যায় ছিল ততদিন আমরা দেখাশোনা করতাম।”
কী কী থাকবে ধন্নীপুরে?
সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াক্ফ বোর্ড সরকারের কাছ থেকে ধন্নীপুরের জমিটা হাতে পাওয়ার পরে তারা ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করে।
ওই ট্রাস্ট বলছে ধন্নীপুরে মসজিদ ছাড়াও অত্যাধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল এবং ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিতে একটি মিউজিয়াম বানানো হবে।
ওই সংগ্রহশালার নাম দেওয়া হবে ফৈজাবাদের বাসিন্দা এবং ১৮৫৭-র লড়াইয়ের শহীদ আহমেদ উল্লা শাহের নামে।
মসজিদের নকশা দুবার বানানো হয়েছে। প্রথমবার দিল্লির অধ্যাপক এসএম আখতার বানিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে অন্য কাউকে দিয়ে নকশা বানানো হয়েছে।
অধ্যাপক আখতার বিবিসিকে বলেছেন যে কেন তার বানানো নকশা খারিজ করা হয়েছে সেটা কমিটির লোকেরাই বলতে পারবে।
ফাউন্ডেশনের সভাপতি জাফর ফারুকি বিবিসিকে বলেছেন মসজিদ নির্মাণের জন্য ১০০ কোটি ভারতীয় টাকা দরকার। এছাড়া অন্যান্য পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত করতে প্রায় ৪০০ কোটি ভারতীয় টাকার দরকার হতে পারে।
অর্থের অভাবে নির্মাণ শুরু হয় নি
ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশনের সভাপতি জঈফর ফারুকি বলছিলেন, অর্থের অভাবে এখনও নির্মাণ কাজ শুরু করা যায়নি। অর্থ জোগাড় করার জন্য একটা কমিটিও হয়েছিল কিন্তু এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে সেটা ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে।
ওই কমিটি সঠিকভাবে কাজ করছিল না বলে জানিয়েছে ফাউন্ডেশন। তবে ওই কমিটিরই এক সদস্য হাজি আরাফাত শেখের ওপরে এখন অর্থ যোগাড়ের দায়িত্ব পড়েছে।
মি. শেখ মুম্বাইতে থাকেন। তার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনও কথা বলতে রাজি হন নি। সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াক্ফ বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি।
অর্থ যোগাড়ের চেষ্টা যেভাবে চলছে
যে হাসপাতালটি গড়া হবে, সেটা পরিচালনার জন্য দাতব্য হাসপাতাল চালায় এমন কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ট্রাস্ট। কয়েকটি সংস্থা এগিয়েও এসেছে।
মি. ফারুকির কথায়, “বিদেশ থেকে অনেকে অর্থ দান করতে ইচ্ছুক। সেই দান নেওয়ার জন্য যে বিদেশি দানগ্রহণ আইনের অধীনে রেজিস্ট্রেশন করার আবেদন করা হয়েছে। ওই রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেলে অর্থের অভাব হবে না।”
তিনি এও জানিয়েছেন যে চাঁদা সংগ্রহের জন্য প্রতিটি রাজ্যে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হচ্ছে আর ক্রাউড-ফান্ডিংয়ের ব্যাপারেও ভাবনা চিন্তা চলছে।
বিজেপির উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি কুয়াঁর বাসিত আলি বলছেন যে ইতোমধ্যেই কমিটির হাতে এক কোটি টাকা আছে।
অযোধ্যায় টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সাংবাদিক আর্শাদ আফজল খান বলছিলেন, “ট্রাস্টের উচিত ছিল কাজ শুরু করে দেওয়া। তারপরে তারা মানুষের কাছে চাঁদা দেওয়ার জন্য আবেদন করতে পারত।”
তবে মানুষের উৎসাহে যে কিছুটা ভাটা পড়েছে, সেটাও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
প্রাচীন বিশ্বের সপ্ত আশ্চর্যের একটি— মিশরের ‘দ্য গ্রেট পিরামিড অব খুফু’র পাশেই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয়েছে ‘দ্য গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম’ বা জিইএম।
এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর বলা হচ্ছে। এখানে রাখা হয়েছে এক লাখেরও বেশি প্রত্নসামগ্রী। প্রাক-রাজবংশীয় সময় থেকে শুরু করে গ্রিক ও রোমান যুগ পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার বছরের ইতিহাস এই জাদুঘরে সংরক্ষিত হয়েছে।
বিখ্যাত মিশরবিদদের মতে, এই জাদুঘর চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে বিদেশে থাকা মিশরের প্রত্নসম্পদ ফেরত আনার দাবি আরও জোরালো হবে। এর মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত বিখ্যাত ‘রোসেট্টা স্টোন’।
তবে জিইএম সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে প্রাচীন মিশরের বালক রাজা তুতেনখামুনের অক্ষত সমাধি থেকে পাওয়া সব প্রত্নসামগ্রী একসঙ্গে প্রদর্শনের কারণে। ব্রিটিশ মিশরবিদ হাওয়ার্ড কার্টার ১৯২২ সালে এই সমাধি আবিষ্কার করার পর এটাই প্রথমবার, যখন তার পুরো সংগ্রহ একসঙ্গে প্রদর্শিত হচ্ছে।
এই প্রদর্শনীতে রয়েছে তুতেনখামুনের সোনার মুখোশ, সিংহাসন, রথসহ নানা মূল্যবান সামগ্রী।
আন্তর্জাতিক মিশরবিদ সমিতির সভাপতি ও জিইএমের সাবেক প্রধান ড. তারেক তওফিক বলেন, ‘কীভাবে এই প্রদর্শনীকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা যায়, তা নিয়ে আমাকে অনেক ভাবতে হয়েছে। কারণ সমাধিটি আবিষ্কারের পর এর সাড়ে পাঁচ হাজার প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে আগে মাত্র ১ হাজার ৮০০টি প্রদর্শিত হয়েছিল। আমি চেয়েছি পুরো সংগ্রহই প্রদর্শন করতে— যেন কেউ শত বছর আগে হাওয়ার্ড কার্টার যেভাবে তা দেখেছিলেন, আজও তেমনভাবেই দেখতে পারেন।’
প্রায় ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই জাদুঘর বছরে অন্তত ৮০ লাখ দর্শনার্থী আকর্ষণ করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি মিশরের পর্যটন শিল্পে নতুন গতি আনবে বলেও মনে করা হচ্ছে।
গিজা পিরামিড এলাকার একজন অভিজ্ঞ গাইড আহমেদ সেদ্দিক বলেন, ‘দ্য গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম মিশরবিদ্যা ও সাংস্কৃতিক পর্যটনের নতুন সোনালি যুগের সূচনা করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’
তুতেনখামুনের প্রদর্শনী এবং খুফুর প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর পুরনো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নৌকা বাদে জাদুঘরের অধিকাংশ গ্যালারি ইতোমধ্যেই দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
গাইড আহমেদ আরও বলেন, ‘আংশিক খোলা থাকার সময়েও আমি বহু ট্যুর আয়োজন করেছি। এখন এটি গৌরবের শিখরে পৌঁছাবে। যখন তুতেনখামুনের পুরো সংগ্রহ উন্মুক্ত হবে, তখন মনে হবে যেন পুরো পৃথিবী ফিরে এসেছে— কারণ এই রাজা শুধু মিশরের নয়, ইতিহাসেরই এক আইকনিক ফারাও।’
লন্ডন থেকে আগত এক পর্যটক স্যাম বলেন, ‘আমরা মিশরের এই নতুন জাদুঘর দেখতে আর প্রত্নসম্পদগুলো উপভোগ করতে মুখিয়ে আছি।’
আরেকজন ব্রিটিশ পর্যটক জানান, তিনি এর আগে কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে অবস্থিত পুরনো মিশরীয় জাদুঘরে তুতেনখামুনের কিছু প্রত্নসামগ্রী দেখেছিলেন।
নতুন জাদুঘরটি প্রায় পাঁচ লাখ বর্গমিটার আয়তনের— যা প্রায় ৭০টি ফুটবল মাঠের সমান। জাদুঘরের দেয়ালে খোদাই করা হয়েছে প্রাচীন মিশরীয় লিপি। অ্যালাবাস্টার পাথরে তৈরি ত্রিভুজাকার দেয়াল আর পিরামিড আকৃতির প্রবেশদ্বার এটিকে দিয়েছে এক অনন্য স্থাপত্যরূপ।
এখানে রয়েছে ৩২০০ বছর পুরোনো এবং ১১ মিটার উচ্চতার রামেসিস দ্য গ্রেটের মূর্তি— যাকে মিশরের অন্যতম বিখ্যাত ফারাও হিসেবে ধরা হয়। ২০০৬ সালে কায়রো রেলস্টেশনের কাছ থেকে এই মূর্তিটি সরিয়ে এনে এখানে স্থাপন করা হয়।
জাদুঘরের বিশাল সিঁড়ির পাশে রয়েছে প্রাচীন রাজা-রানীদের ভাস্কর্য। উপরের তলার বড় জানালা দিয়ে দর্শনার্থীরা সরাসরি গিজা পিরামিডের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।
এই জাদুঘর নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয় ১৯৯২ সালে, আর কাজ শুরু হয় ২০০৫ সালে। অনেকের মতে, এটি নির্মাণে সময় লেগেছে প্রায় পিরামিড নির্মাণের সমান।
তবে এই প্রকল্প বারবার স্থগিত হয়েছে রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে। ২০১১ সালের আরব বসন্ত, পরবর্তী সময়ের অশান্তি, কোভিড মহামারি ও আঞ্চলিক সংঘাতের সময় কাজ থমকে যায়।
দেশটির সাবেক পর্যটনমন্ত্রী ও বিশিষ্ট মিশরবিদ ড. জাহি হাওয়াস বলেন, ‘এটা ছিল আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। আজ এই জাদুঘর পুরোপুরি চালু হতে দেখে আমি সত্যিই আনন্দিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমি দুটি বিষয় চাই— প্রথমত, বিশ্বজুড়ে জাদুঘরগুলো যেন চুরি করা প্রত্নবস্তু কেনা বন্ধ করে। দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে থাকা রোসেট্টা স্টোন, ফ্রান্সের লুভ জাদুঘরে থাকা ডেনডেরা জোডিয়াক, এবং জার্মানির বার্লিন জাদুঘরে থাকা নেফারতিতির মূর্তিটি যেন ফেরত আসে।’
রোসেট্টা স্টোন হায়ারোগ্লিফিক লিপি পাঠোদ্ধারের অন্যতম চাবিকাঠি হিসেবে পরিচিত। এটি ১৭৯৯ সালে ফরাসি সেনারা আবিষ্কার করেছিল, পরে ব্রিটিশরা যুদ্ধের পর দখল করে নেয়।
অন্যদিকে, ডেনডেরা জোডিয়াক একটি প্রাচীন মিশরীয় আকাশ মানচিত্র, যা ১৮২১ সালে ফরাসিরা মন্দির থেকে কেটে নিয়ে যায়। মিশরের দাবি, জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিকরাও আখেনাতেনের স্ত্রী নেফারতিতির মূর্তি পাচার করে নিয়েছিল।
ড. হাওয়াস বলেন, ‘ওই তিন দেশ থেকে এগুলো ফিরিয়ে আনা উচিত সৌহার্দ্যের নিদর্শন হিসেবে। মিশর বিশ্বকে অনেক কিছু দিয়েছে, এখন তাদেরও কিছু ফেরত দেওয়া সময় এসেছে।’
তবে ব্রিটিশ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা এ বিষয়ে মিশরের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পায়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হিসেবে শপথ নেওয়া দুই উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না, তা নিয়ে রাজনীতির মাঠে জোর আলোচনা চলছে।
আগেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন আসিফ মাহমুদ। তবে কোনো দলের প্রার্থী হবেন না কি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াবেন— সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেননি বলে জানিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে মাহফুজ আলম নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন বলে কয়েক দিন আগে এনসিপির এক সভায় বক্তব্য দেন তার ভাই মাহবুব আলম।
সম্প্রতি বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে কয়েকজন উপদেষ্টার বিষয়ে তাদের আপত্তি জানান।
এ নিয়ে চলমান আলোচনার মধ্যেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দুই উপদেষ্টাকে পদত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে দুই উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে সূত্র বলছে, নির্বাচন ঘিরে নানা সমীকরণে এখনই পদত্যাগের কথা ভাবছেন না তারা।
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে এই দুজনসহ তিনজন জায়গা পান।
সরকারে যাওয়া তিনজনের মধ্যে নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করে যোগ দেন আন্দোলনের সামনের সারির নেতাদের নিয়ে গঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-তে।
সরকারের ওপর এনসিপির প্রভাব বিস্তারে পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থী উপদেষ্টাদের যে ভূমিকা ছিল, নাহিদ ইসলামের পদত্যাগের পর তার অনেকটাই কমে গেছে।
ফলে বাকি দুজন উপদেষ্টাও যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে সরকারের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরার শঙ্কা আছে এনসিপির মধ্যে।
নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারীর পদত্যাগ নিয়ে গুঞ্জন
এনসিপি থেকে দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী পদত্যাগ করছেন— বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) এমন একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে।
সূত্রের বরাতে প্রকাশিত খবরগুলোয় বলা হয়, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সরকার থেকে পদত্যাগ করে এনসিপিতে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছেন।
সেক্ষেত্রে দলে এসে নির্বাচন ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তিনি, যাতে সমর্থন দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
কিন্তু বর্তমানে ওই দায়িত্বে থাকা নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী এ সিদ্ধান্তে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন বলে খবর প্রকাশিত হয়।
যদিও ‘পদত্যাগের বিষয়টি কিংবা দল থেকে অব্যাহতি নেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়’ জানিয়ে রাতেই এক বিজ্ঞপ্তি দেয় এনসিপি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন সামনে রেখে দলের অভ্যন্তরে শীর্ষ পদগুলোতে কিছু পরিবর্তনের আলোচনা চলছে। সেখান থেকেই এই গুঞ্জনের সূত্রপাত হতে পারে।
এমনকি আসিফ মাহমুদের এনসিপিতে যোগ দেওয়ার গুঞ্জনও সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন একাধিক এনসিপি নেতা।
বরং বিএনপির সঙ্গে ‘নেগোসিয়েশন’ করে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ভাবছেন— এমন গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে।
সেক্ষেত্রে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বা পরে পদত্যাগ করতে পারেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
মাহফুজ আলমের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে আলোচনা
গত ১৭ অক্টোবর লক্ষ্মীপুরে এনসিপির এক সভায় উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ভাই মাহবুব আলম বলেন, ‘আগামী সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনে প্রার্থী হতে পারেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।’
গত মাসের শেষের দিকে এক সংলাপে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে আমি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি— আমি কখন নামব, জানি না।’
রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে পদত্যাগ চাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি এ কথা বলেন।
ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের চাপ এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া— এই দুই দিক থেকেই মাহফুজ আলমের পদত্যাগের আলোচনা সামনে এসেছে।
কিন্তু নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে যে সমীকরণ দেখা যাচ্ছে, তাতে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের দুজনই যদি পদত্যাগ করেন এবং গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউই যদি সরকারে না থাকেন, তবে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না বলে মনে করছেন গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া নেতারা।
আর তাই আসিফ মাহমুদ নির্বাচনে অংশ নিলেও মাহফুজ আলম নির্বাচন না করে সরকারে থাকার কথাই ভাবছেন বলে তাদের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে।
উপদেষ্টাদের পদত্যাগের আলোচনা, কীভাবে দেখছে এনসিপি
নির্বাচনের আগে কেবল শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে হওয়া দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ চাওয়ার বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখছেন এনসিপি নেতারা।
রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দুই উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি এবং সরকার থেকে তাদের পদ ছাড়ার পরামর্শকে তারা পরিকল্পিত বলেই মনে করছেন।
তাদের মতে, নানা পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছিল। গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবেই তারা সরকারে গেছেন।
কিন্তু সরকার গঠনের ছয় মাস পর আত্মপ্রকাশ করা এনসিপির সঙ্গে তাদের মিলিয়ে প্রচারণা চালানো কিংবা পদত্যাগ করতে বলা উদ্দেশ্যমূলক।
‘দুই উপদেষ্টাকে দলীয় হিসেবে দেখানোর প্রবণতা যদি থেকে থাকে, তবে অনেক উপদেষ্টাই আছেন যাদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। তারা সরকারের ভেতরে থেকেই কোনো না কোনো দলকে সমর্থন করে যাচ্ছেন,’ বলেন এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন।
তার দাবি, কেবল পূর্বতন রাজনৈতিক পরিচয় বা সখ্যতার বিষয়কে দলীয় হিসেবে বিবেচনা করা হলে সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনেকেরই বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে গভীর সখ্যতা রয়েছে।
ফলে তাদের জায়গাটাও পুনর্গঠন করা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়বে?
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী ও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি যুক্ত করা হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে নানা ইস্যুতে আলোচনায় এক ধরনের ভারসাম্যও দেখা গেছে।
কিন্তু দল গঠনের জন্য নাহিদ ইসলামের পদত্যাগের পর সরকারের ওপর শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।
এরই মধ্যে এগিয়ে আসছে নির্বাচন। এনসিপি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠছে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি দুই উপদেষ্টার বিরুদ্ধে।
রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণের আগ্রহ থাকলেও আরও কিছু সময় ক্ষমতা ধরে রাখার উদ্দেশ্যে ওই দুই উপদেষ্টা এখনই পদত্যাগ করছেন না।
‘ক্ষমতার চেয়ারে থাকার লাভ তো অন্যরকম। যতদিন আপনি ক্ষমতার চেয়ারে, ততদিন আপনি প্রভাব-প্রতিপত্তি উপভোগ করতে পারবেন,’ বলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ।
তবে নির্বাচনের নিরপেক্ষতার স্বার্থে শিক্ষার্থী উপদেষ্টাদের ‘চলে যেতে হবে’ বলেই মত তার।
এমনকি আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলম পদত্যাগ করলেও সরকারের সঙ্গে এনসিপির সম্পর্ক খারাপ হবে না বলে মনে করেন সাব্বির আহমেদ।
তার মতে, এই শিক্ষার্থীরা অধ্যাপক ইউনূসকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। আর এনসিপি গঠনের ক্ষেত্রেও তার নিজস্ব আগ্রহ কাজ করেছে।
ফলে কেবল পদত্যাগ করলেই ‘এনসিপির পেছন থেকে মেন্টর হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস চলে যাবেন, সেটা ভাবার এখনই সময় আসেনি,’ মন্তব্য করেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি