বাংলাদেশে ডেঙ্গু আজ আর কোনো মৌসুমী অসুখ নয়, বরং এক অব্যাহত জনস্বাস্থ্য সংকট। বছরের নির্দিষ্ট সময় নয়, এখন প্রায় সারাবছরই এডিস মশার দাপটে দেশজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত কয়েক বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপ ও মৃত্যুহার বেড়েছে বহু গুণ, আর এই বাড়তি ভয়াবহতার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন উঠছে—এই বিপর্যয় ঠেকাবে কে?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ, প্রাণ হারিয়েছেন দুই শতাধিক। সংখ্যাটি শুধু পরিসংখ্যান নয়, এটি একেকটি পরিবারের অকাল বেদনার ইতিহাস। আরও উদ্বেগজনক হলো, সেপ্টেম্বর মাসে আক্রান্তের সংখ্যা একলাফে প্রায় ১৬ হাজারে পৌঁছেছে—যা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছে, অক্টোবরে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার নিতে পারে।
রাজধানী ঢাকাই এই রোগের মূল কেন্দ্র। তবে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, ময়মনসিংহ, সিলেট—কোনো জায়গাই এখন নিরাপদ নয়। শহর থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। আগে ডেঙ্গু ছিল নগরজীবনের সমস্যা, এখন তা গ্রামীণ জনপদেও পৌঁছে গেছে। এটি শুধু স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা নয়, বরং পুরো ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতার এক নগ্ন চিত্র।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো তরুণ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বৃদ্ধি। যারা পড়াশোনা করে, কাজ করে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়—তাদেরই বড় অংশ আজ হাসপাতালের বিছানায় বা রক্তস্বল্পতার যন্ত্রণায়। এর মানে, ডেঙ্গু কেবল স্বাস্থ্য নয়, অর্থনীতিতেও এক গভীর আঘাত হানছে। একটি পরিবারের একজন সদস্য আক্রান্ত হলে শুধু চিকিৎসার ব্যয় নয়, তার কর্মক্ষমতা হারানোর চাপেও পুরো পরিবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কেন প্রতিবছর একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি দেখি?
উত্তর খুঁজতে গেলে সামনে আসে তিনটি কারণ।
প্রথমত, সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকারের মশক নিধন কার্যক্রম এখনো দেখনদারিতেই সীমাবদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযানগুলো কাগজে থাকে, মাঠে নয়। মশা নিধনের কার্যকর উপায়, ওষুধ ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞানভিত্তিক কৌশল— সবকিছুরই অভাব স্পষ্ট।
দ্বিতীয়ত, জনগণের সচেতনতা খুবই সীমিত। ঘরের ভেতর-বাইরে জমে থাকা অল্প পানিই এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র হয়ে উঠছে। ফুলের টব, ড্রাম, পুরনো টায়ার, নির্মাণাধীন ভবনের বালতি— সবখানেই জন্ম নিচ্ছে নতুন বিপদ। কিন্তু এখনও অধিকাংশ মানুষ এই বিষয়টিকে ব্যক্তিগত দায়িত্ব হিসেবে নিচ্ছেন না।
তৃতীয়ত, দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবেশ অধিদপ্তর—সবাই যেন নিজ নিজ সীমারেখায় আটকে আছে। ফলে যৌথ ও টেকসই উদ্যোগ গড়ে উঠছে না।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ শুধু মশা মারার বিষয় নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা চায়। প্রতিটি নাগরিককে জানতে হবে, তার আশপাশ পরিষ্কার রাখা শুধু সামাজিক নয়, ব্যক্তিগত নিরাপত্তারও বিষয়। অন্যদিকে সরকারকে বুঝতে হবে— এটি এখন কেবল একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতির সঙ্গেও যুক্ত।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়ও এখন জরুরি প্রস্তুতি বাড়ানো প্রয়োজন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত শয্যা, চিকিৎসক, নার্স, প্লাটিলেট ও রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। জেলা ও উপজেলা হাসপাতালেও পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা না থাকলে ঢাকায় চাপ বাড়বে, যা পুরো ব্যবস্থাকে ভেঙে দেবে।
এখনই সময় সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দায়সারা মনোভাব ত্যাগ করে মাঠে নামার। অটো-ডিসেমিনেশন ট্র্যাপ বা জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি দ্রুত প্রয়োগে আনতে হবে। পাশাপাশি গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জনসচেতনতা তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।
ডেঙ্গু আর কোনো একক সংস্থার লড়াই নয়— এটি গোটা জাতির লড়াই। সরকারের নীতিনির্ধারক, স্থানীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্যকর্মী ও নাগরিক— সবার মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই ভয়াবহতা রোধ সম্ভব নয়।
অক্টোবর মাসকে আমাদের শেষ সতর্কবার্তা হিসেবে নিতে হবে। আজ যদি আমরা সচেতন না হই, দায়িত্ব না নেই, কার্যকর পদক্ষেপ না নিই— তাহলে কাল হয়তো ডেঙ্গু কেবল সংখ্যা নয়, এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের নাম হয়ে উঠবে।
২৬ বছর বয়সী ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার সৃষ্টিশীল তরুণী স্বর্ণময়ী বিশ্বাস। তিনি আর নেই! এই অল্প বয়সে, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টাতে, এক সৃজনশীল তরুণী নিজের জীবনের পরিসমাপ্তি নিজে টেনে দিলেন। তার সাদাকালো ছবির মৃদু হাসিটা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে— একটি মেয়ে, যে একসময় রঙে রঙে সাজাতো নিউজ প্লাটফর্মের দেয়াল, এখন হয়ে গেছে অনন্ত শূন্যতার প্রতীক। কেন এমন হলো? কে দায় নেবে এই মৃত্যুর?
সবাই এখন বলছে, হয়তো মানসিক চাপ, হয়তো পারিবারিক জটিলতা, হয়তো ব্যক্তিগত দুঃখ— হাজারটা ‘হয়তো’। কিন্তু আমরা জানি, ‘হয়তো’র আড়ালে একটা নিশ্চিত সত্য লুকিয়ে থাকে— স্বর্ণময়ী বিশ্বাস এক অসুস্থ কর্মপরিবেশে নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। ঢাকা স্ট্রিম নামে নতুন একটি সংবাদ মাধ্যমে তিনি ছিলেন। সেই অফিসে, কোনো এক ব্যক্তির বিষাক্ত আচরণ নারী সহকর্মীদের শ্বাসরোধ করে দিয়েছিল। ব্যক্তিটির নাম আলতাফ শাহনেওয়াজ।
আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগ, পেশাগত কোনো কারণ ছাড়াই ‘গভীররাতে’ নারী সহকর্মীদের ফোন দেন তিনি। সিঁড়িতে আলাদা ডেকে কথা বলতেন। ছেলেবন্ধু আছে কি না, থাকলে তার সাথে সম্পর্ক কতখানি গভীর, শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কি না— এমনসব ব্যক্তিগত বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেন।
নতুন প্রতিষ্ঠান হওয়ায় অনেকে সেখানে নিয়োগপত্র ছাড়াই কাজ শুরু করেছেন। এমন নারী কর্মীদের গভীররাতে ফোন করে আলতাফ বলতেন, ‘ঠিকঠাক কাজ না করলে নিয়োগপত্র দেওয়া হবে না’।
তাছাড়া অফিসে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই নারীদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতেন। এমননি মেজাজ হারিয়ে নারী সহকর্মীদের সাথে চিৎকার-চেঁচামেচিও করতেন।
এই আলতাফরা শুধু একজন ব্যক্তি নয়, তারা এক মানসিকতা— যে মানসিকতা ক্ষমতা, পদের দাপট আর পুরুষতান্ত্রিক শ্রেষ্ঠত্ববোধে ভরপুর। তারা ভাবে, নারী সহকর্মী মানে তার সাথে যা খুশি করা যায়। তাকে অপমান করে, ছোট করে, যৌন হেনস্থার শিকার করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানো যায়। তারা ভাবেই না, একটা খারাপ শব্দ, একটা কু-ইঙ্গিত, একটা বাজে মন্তব্য একজন নারীর আত্মমর্যাদাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে।
স্বর্ণময়ী বিশ্বাসসহ ২৬ জন সহকর্মী এই বিষাক্ত আচরণের জন্য আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু তারপর? ঢাকা স্ট্রিম, ‘আধুনিক’, ‘পেশাদার’ প্রতিষ্ঠান বলে যারা নিজেদেরকে দাবি করে, তারা কী করল? তারা অভিযুক্তকে ‘বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহার’ করল— কাগজে কলমে। বাস্তবে সেই মানুষটাই থেকে গেল ক্ষমতার কেন্দ্রে। আর যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল প্রতিবাদী, তাদের কয়েকজনের চাকরি গেল, মূল্যায়নে ‘অসন্তোষজনক’ হয়ে গেলেন তারা।
বাংলাদেশে এটা নতুন কিছু নয়। এখানকার অনেক কর্মক্ষেত্রই নারীদের জন্য নিরাপদ নয়। কিন্তু আরও ভয়ংকর হলো, অভিযোগের পরের নীরবতা। আমরা বারবার দেখি— একজন নারী প্রতিবাদ করে, অভিযোগ করে, তারপর ধীরে ধীরে সব নিঃশব্দ হয়ে যায়। কারণ চারপাশের মানুষ বলে, ‘এতে অফিসের নাম খারাপ হবে’, ‘তুমি অতিরঞ্জিত করছো’, ‘এইসব নিয়ে ঝামেলা কোরো না’। আর সেই নীরবতার মধ্যেই একজন স্বর্ণময়ী বিশ্বাস নিজের ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশে উচ্চ আদালত ২০০৯ সালে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নারী হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি থাকতে হবে, বাইরের সদস্যসহ তদন্ত হবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। কিন্তু বাস্তবে কোনো প্রতিষ্ঠান কি সেই নির্দেশ মানে? ইউনেস্কো ও ডয়চেভেলের গণমাধ্যম সক্ষমতা গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ গণমাধ্যমে এমন কমিটি নেই। নেই অভিযোগ শোনার, তদন্ত করার, ন্যায়বিচার দেওয়ার কোনো কাঠামো।
এই ব্যর্থতাই স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর পেছনের আসল অপরাধী। এই ব্যর্থতাই আলতাফদের বাঁচিয়ে রাখে, শক্ত করে দেয় তাদের আসন। তাদেরকে আবারও কোনো স্বর্ণময়ীকে উত্যক্ত করার প্ররোচনা দেয়। এই ব্যর্থতাই একের পর এক নারীকে নিঃশেষ করে দেয়— কখনো আত্মহত্যায়, কখনো নীরবতায়।
আমাদের নিষ্ক্রিয়তার দায় নিয়ে চলে যায় স্বর্ণময়ীরা। আমাদের সমাজ, কর্মক্ষেত্র, বিচারব্যবস্থা— সব মিলিয়ে আমরা তাকে ঠেলে দেই আত্মহননের পথে।
স্বর্ণময়ীরা মরে যায়, কারণ তাদের বাঁচিয়ে রাখার সিস্টেম নেই। আলতাফরা টিকে যায়, কারণ তাদের রক্ষা করার সিস্টেম আছে। তারা ম্যানেজমেন্টের প্রিয়, সম্পাদকীয় টেবিল বা সিদ্ধান্ত নির্মাতা চক্রের সদস্য। তারা জানে— যত অভিযোগই উঠুক, শেষমেশ তাদের কিছুই হবে না।
কিন্তু যদি আমরা সত্যিই কিছু পরিবর্তন চাই, তাহলে এখনই দরকার এই আলতাফদের নাম, চেহারা, আচরণ সমাজের সামনে আনা। দরকার কর্মক্ষেত্রে অভিযোগ নিষ্পত্তির স্বচ্ছ ও বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা। দরকার নারী কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ইচ্ছাশক্তি।
স্বর্ণময়ী বিশ্বাসকে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারবো না। কিন্তু আমরা পারি— পরবর্তী স্বর্ণময়ীকে হারানো থেকে বিরত থাকতে। আমরা পারি— কোনো অফিস, কোনো নিউজরুম, কোনো আলতাফকে আর কাউকে মেরে ফেলতে না দিতে।
যেদিন আমাদের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে একজন নারী নির্ভয়ে কাজ করতে পারবে, যেদিন সে জানবে— অভিযোগ জানালে তার চাকরি যাবে না, বরং অপরাধীর বিচার হবে, সেদিনই আমরা বলতে পারবো— স্বর্ণময়ীরা আর মরে না, আলতাফরা আর টিকতে পারবে না।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর জন্মদিন আজকে নাকি গতকাল ছিল? ২৪শে মে হিসেবে গতকাল অনেকেই জন্মদিন উদযাপন করছেন। ১১ই জ্যৈষ্ঠ হিসেবে আজ উদযাপন করছে অনেকে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহও আজ উদযাপন করছে। তবে এই দ্বন্দ্বের কি সমাধান আছে কোনো?
শুরুতে যে বললাম, জাতীয় কবি– এই স্বীকৃতিও তো কেবলই মুখেমুখে। সরকারের কোনো আনুষ্ঠানিক দলিলপত্রে জাতীয় কবি হিসেবে তো স্বীকৃতি মেলেনি। জাতীয় পর্যায়ে ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আয়োজনে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে লেখা হয়। তবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, জাতীয় আর্কাইভ, নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির কোথাও নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা সংক্রান্ত সরকারি কোনো প্রজ্ঞাপন বা অন্য কোনো দলিল নেই। লোকমুখে প্রচারিত তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি, কাগজে-কলমে প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে নন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে সপরিবার ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশে আসার পর কবির জন্য ধানমন্ডিতে সরকারি উদ্যোগে একটি বাড়ি বরাদ্দ করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় ‘কবি ভবন’। সেখানে কবিকে রাখা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর এক বিশেষ সমাবর্তনে কবিকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। তাঁকে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করা হয়। এসকল সম্মানই তাঁকে দেয়া হয়েছে ঠিকই। তবে জাতীয় কবি স্বীকৃতিটা এখনো মুখে মুখেই রয়ে গেছে।
এটা সত্যি যে সরকারি দলিলে বিভিন্ন প্রসঙ্গে নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁকে জাতীয় কবি উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশও প্রণীত হয়েছে। এটি পরোক্ষ স্বীকৃতি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কেবল মৌখিক বিষয় নয়, আনুষ্ঠানিকতা ও সার্বভৌম শক্তির দাপ্তরিক ঘোষণার বিষয়টিও এর সঙ্গে যুক্ত। ভবিষ্যতের জন্য স্বীকৃতি সংরক্ষণের বিষয় থাকে। এসব বিবেচনায় আনুষ্ঠানিকভাবে নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
২০১৯ সালে এ বিষয়ে তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেছিন, তাঁর মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করার কথা বলেছেন তিনি। খুব শিগগির এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু হবে। কিন্তু তার দুইবছর পর ২০২১ সালে তিনি মত পাল্টে বললেন, ‘জাতীয় কবির স্বীকৃতি সম্মানের, গেজেটভুক্তির বিষয় নয়’। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোবেসে যেমন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে, তেমনি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তার কর্মের স্বীকৃতি ও সম্মানস্বরূপ ‘জাতীয় কবি’ উপাধি দেওয়া হয়েছে। ‘জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি যেমন অবিচ্ছেদ্য, তেমনি ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ ও ‘জাতীয় কবি’ উপাধি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জাতীয় কবির স্বীকৃতি সম্মানের, গেজেটভুক্তির বিষয় নয়।
জাতীয় কবি স্বীকৃতির জন্য তৎকালীন মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না আমাদের কাছে। ভালোবাসার সম্বোধন আর রষ্ট্রের ‘জাতীয়’ কোনো বিষয়ের স্বীকৃতিকে এক মাপকাঠিতে বিচারের কোনোরকম সুযোগই নেই। বরং প্রশ্নটা হলো, এই স্বীকৃতি গেজেট আকারে দিতে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত সব সরকারেরই সংকোচ কেনো? সমস্যাটা ঠিক কোথায়?
কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবির প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে নজরুল ইনস্টিটিউটের উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করি। এই স্বীকৃতির বিষয়টি অবশ্যই গেজেট আকারে প্রকাশ করা উচিত।
বর্তমান সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খানের কাছে দাবি জানাই, এ বিষয়ে দ্রুত প্রযোজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার।