কিভাবে লিখলাম ‘কাঁটাতারের পরিযান’

Post Thumbnail

২০১০সাল থেকেই ঢাকা থিয়েটারের সাথে জড়িত। ছোট খাটো ডায়লগ লেখা, নাটক গুছিয়ে লেখা এসব করতেই করতে বই নিয়েই সময় কাটতো ঢেরবেশি। বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা আর শখের ছবি আঁকার পাশাপাশি কিছু কিছু লেখা যেনো আসতে শুরু করলো ভেতর থেকে। কতশত কবিতা লিখিয়ে নিলো প্রেমিকেরা, কিছু লিখতাম প্রেমের শুরুতে আর কিছু লিখতাম প্রেমের শেষে। ওই যাকে বলে বিরহে। আমার ভেতর এই দুইধারি তালোয়ারের খোঁজ আমিও তখন পাইনি সত্যি। কিন্তু বইয়ের ভেতর, খাতার মাঝে, ব্যাগে একটা ডায়েরি থাকবেই থাকবে আমার তা যেনো ছিলো বাধ্যতামূলক। যেখানেই যা দেখতাম তা নিয়ে যেনো কিছু লিখে ফেলা, কিছু বলতে চাওয়া। কিন্তু আমাদের সমাজে মুখে কুলুপ এঁটে থাকায় যেখানে রীতি সেখানে লিখবো কী আমি আর ভারি!

ইউনিভার্সিটির শেষের দিকের কথা হবে। হাস্যরসিক এক বান্ধবী ছিল আমার, নাম জেরিন। সেই সময় তাদের বাসায় যাওয়া, উঠাবসা খুব হতো। ভালো পরিবার ছিলো তাদের। বলতে গেলে বনেদী ব্যাপারটা আমি প্রথম ওই বাসাতেই দেখি। যেমন রূপোর বাটিতে খাবার দেয়া, কাঁসার গ্লাসে পানি দেয়া। সংসারের চারদিক ঝলমল করছে কাঁসার সোনালি রঙে আর রুপোর ছিটকে আসা উজ্জ্বলতায়। ওসব দেখে আমরা অভ্যস্ত নই বলেই আমাদের আগ্রহ একটু বেশিই ছিল বৈকি জেরিনকে নিয়ে।

ক্লাস সেরে বা ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের আড্ডাটা হতো সিদ্ধেশ্বরী পি.বি.এস-এর ভেতর অথবা বাইরে। কয়েকমাস ধরেই খেয়াল করলাম জেরিন আর সেই আড্ডায় আসে না। নতুন প্রেম হয়েছে দেখে সবাই হাসাহাসি আর রসিকতা করেই অগ্রাহ্য করলাম আপাতত। সেমিস্টার ফাইনাল চলে আসলো, জেরিনের পাত্তা নাই। অনেকেরই পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের দাওয়াতও খাচ্ছি দলবল মিলে। কেউ বিয়ের পর পড়া চালাচ্ছে, কেউ আর পড়ছে না। এসব সহনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো ততদিনে। কিন্তু জেরিনের মতো কেউ লাপাত্তা হয়ে যায়নি। ফোন দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। আমার বাড়তি আগ্রহ দেখে সবাই বলতে লাগলো জেরিন তোরে ছ্যাকা দিয়া চইলা গেছে। এখন ছ্যাকা হোক আর বোকা হোক, ভেতরটা জায়ফলের মতো খটমট করতে লাগলো। ততদিনে এটুকু বুঝতাম জয়ত্রী আর জায়ফল হলো সুখ আর দুঃখের মতো একই গাছের দুই ফল। জয়ত্রী হলো ওপরের অংশটুকু যা সুখ আর ভেতরে খুটখুট করতে থাকা দুঃখের বীজটি হলো জায়ফল।

যাইহোক সেমিস্টার ফাইনালের শেষের দিকে চলে গিয়েছিলাম। তার মাঝেই নিজেরও বিয়ের কথা চলছে। সব নিয়ে জেরিন যেনো ভাবনা থেকে অনুপস্থিত। বিয়ের দিন যেদিন হলুদ মাখানো হবে আর কিছুক্ষণ পর, আমার খুব করে মনে হলো জেরিনের কথা। কী জানি কী? আগপাছ কিছু না ভেবেই ছুটলাম শান্তিনগর জেরিনের বাড়ি। যেয়ে জানতে পারলাম এক ভয়ংকর সত্য। প্রেম করেছিলো জেরিন হিন্দু বংশের এক ছেলের সাথে। বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেয়াতে পালিয়ে বিয়ে করেছিলো দুইজন।কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। এক বাসা ভাড়া করে সেই ছেলে তাকে ফেলে রেখেছিলো দিনের পর দিন। সামাজিক স্বীকৃতি দেয়া তো দুরস্ত, জড়িয়েছিল অন্য এক প্রেমে। আত্মহত্যার পথ সহজ মনে হয়েছিলো আমাদের সেই হাসিখুশি ছটফটে জেরিনের।

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে গেলাম, কেন জানি জেরিনের মায়ের কান্নাও খুব অসহ্য লাগছিলো। বেশিক্ষণ না থেকেই হেঁটে হেঁটে বাড়ি আসলাম। ভেতরে তোলপাড় আর মরা মাছের চোখ নিয়েই বসলাম বিয়ের পিঁড়িতে। অনেকেই আমার সেই উদাসীনতা দেখে ভেবেছিলো বিয়েতে বুঝি কনের সম্মতি নেই। কথায় আছে না ডেরা সাপে না কাটলেও অভিশাপে কাটে শত। আমার দশা তেমন। ডেরা সাপ মানে প্রেমে ছ্যাকা খাইনি তো কী হয়েছে? মানুষের মুখে মুখে রটে গেলো আমার বুঝি আগে প্রেম ছিলো।ভাগ্যিস বর বুঝদার ছিলো। তাই বিয়েটা খোঁটা ছাড়াই সম্পন্ন হলো। কিন্তু হলে কী হবে, ওই যে জায়ফল খুটখুট করছে মনের ভেতর তার কী হবে?

লিখতে বসলাম আমার জীবনের প্রথম উপন্যাস। ‘কাঁটাতারের পরিযান’। জেরিনকে মাথায় রেখে লিখলেও পালটে দিলাম নাম, ধর্ম। প্রধান চরিত্রের নাম রাখলাম সেঁজুতি। সেঁজুতিকে যথারীতি বাবা ত্যাজ্য করে ঘর থেকে বের করে দেয় মুসলমান তনয়-এর সাথে প্রেম করার পাপে। তনয়ের নামে ছাদনা তলায় সিঁথিতে সিঁদুর পরে সেঁজুতি ঠিকই কিন্তু শেষ পরিনতি হিসেবে সংসার করা হয়ে ওঠে না দুজনের। তবে জেরিনের যে অপমৃত্যু তার প্রতিবাদে আমার গল্পের নায়িকার আত্মহত্যা আমি লিখিনি।

আমি লিখেছি সেঁজুতির ঘুরে দাঁড়ানোর কথা যা চাইলে মেধাবী জেরিনও করতে পারতো। আমি লিখেছি সেঁজুতির মায়ের চরিত্রে আরেকজন শক্তিশালী নারী আন্না বসুর কথা যে বাবা আর মেয়ের মাঝে সেতু হয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করেছে চৌকস বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।সেঁজুতির মনোবল আর আন্না বসুর বুদ্ধিমত্তা ও উদারতা সমাজে লিখে রাখতে চেয়েছি দৃষ্টান্ত হিসেবে। যদি কোন ঘরের মা, সন্তানের বিপদে দশভুজা দুর্গার মতো সব বিপদকে মোকাবিলা করে আর সমাজের মুখে চপেটাঘাত মারতে পারে তাহলে সমাজে কোন সন্তান আর মৃত্যু সহজ মনে করবে না বেঁচে থাকার চেয়ে।

সেঁজুতি আর আন্না বসু তাই শুধু আমার উপন্যাসের চরিত্রই না বরং তারা সব প্রশ্নের জবাব যা যুগ যুগ ধরে নারীদেরকে দুর্বল করে রেখেছে কখনো প্রেমের নামে, কখনও শরীরের নামে, আবার কখনও সমাজ সংসারের রাস্তায় রাস্তায়। হেরে যাওয়া মানুষের উঠে দাঁড়ানোর গল্প, সমাজকে নতুন করে সাজানোর দুই অনন্যসাধারণ চরিত্র সেঁজুতি আর আন্না বসু লিখে নিজের কাছেই মনে হয়েছে– এ যেনো আমি লিখিনি, কোন এক অদৃশ্য যেনো আমাকে দিয়ে লিখিয়েই নিয়েছে।