শিল্প-সাহিত্য

শিল্প-সাহিত্য

নিন্দুকেরা শক্তিশালী হলেও তারা পরাজিতের বংশধর : তপন বাগচী

ড. তপন বাগচী একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক এবং লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি গবেষক। বাংলা একাডেমির ফোকলোর, জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন ফোকলোর চর্চায়। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩-এ ফোকলোর ক্যাটাগরিতে সম্প্রতি পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি। তাঁর লেখক হয়ে ওঠা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, পুরস্কারসহ নানা বিষয়ে রোজকার খবরের সম্পাদক মেহেদী হাসান শোয়েব কথা বলেছেন এই গুণী লেখক, গবেষকের সঙ্গে।

মেহেদী হাসান শোয়েব : বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন। স্বাভাবিকভাবেই আজকের প্রথম প্রশ্ন এই পুরস্কার প্রাপ্তির অনুভূতি নিয়েই। আমরা জানি বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য আপনার নাম অনেক বছর ধরেই প্রস্তাব আসছিল। কিন্তু পেলেন এবছর। একটু কি দেরি করেই পেলেন আপনি? কেমন অনুভূতি আপনার?

তপন বাগচী : মোটেই দেরি হয়নি। সত্তর বছর পেরিয়েও অনেক লেখক এই পুরস্কার পেয়েছেন, সেখানে আমি কেবল ছাপ্পান্নর কোঠায়। তাছাড়া পুরস্কারের জন্য তো কোনো বয়স বেঁধে দেওয়া নেই। প্রস্তাবকরা হয়তো আগেও প্রস্তাব করেছেন, কিন্তু জুরি বোর্ড যখন সন্তুষ্ট হবেন, তখনই তো পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আমি মনে করে কর্তৃপক্ষ যখন যোগ্য মনে করেছেন তখন দিয়েছেন। কাজের স্বীকৃতি পেলে একধরনের ভালোলাগা কাজ করে। আরও নতুন কাজের প্রেরণা পাওয়া যায়। সরকারপ্রধান মাননীয় শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণের অনূভূতি তো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আর কেবল তিনি সরকারপ্রধানই নন, তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা। এই পুরস্কার মানে জাতীয় স্বীকৃতি। আমি অভিভূত, উদ্বেলিত, উচ্ছ্বসিত।

মেহেদী হাসান শোয়েব : পুরস্কারপ্রাপ্তি একজন লেখকের উপর কী প্রভাব ফেলে? অনেকে বলেন যে লেখকের দায়িত্ব বা দায় বাড়ায়। কিন্তু পুরস্কার কি দায়িত্বশীল লেখকের স্বীকৃতিই না? আপনি কিভাবে দেখেন বিষয়টাকে?

তপন বাগচী : কোনও লেখক পুরস্কারের জন্য লেখেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। তবে হ্যাঁ, পাঠকের ভালোলাগাকে যদি পুরস্কার হিসিবে গণ্য করা হয়, তবে ওই পুরস্কার অবশ্যই কাম্য। আর প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি বা পারিতোষিককে যদি পুরস্কার হিসেবে ধরা হয়, তবে তারও প্রভাব রয়েছে। প্রথমত ওই পুরস্কারের পরে লেখককে যেহেতু অনেকের মধ্য থেকে সনাক্ত করা হয়, তাই তার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ে। পারিতোষিক কাজে লাগে বৈষয়িক প্রয়োজনে। আর পুরস্কারের ফলে দায়িত্ব বাড়ে, সেই কথাটিও পুরোপুরি আমি বিশ্বাস করি না। লেখক নিজে থেকেই দায়িত্বশীল না হলে তার লেখার অধিকার থাকে না। লালনকে কে পুরস্কার দিয়েছিল? আজকে তাঁর চেয়ে নন্দিত লেখক কজন? এটিই তো তাঁর পুরস্কার। তবে সরকারপ্রধানের হাত থেকে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার গ্রহণ অবশ্যই আমার আত্মবিশ্বাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার আর থামার সুযোগ নেই। এই পুরস্কার আমাকে এই শক্তি দিয়েছে।

মেহেদী হাসান শোয়েব : আপনি লেখক কেনো হলেন? এই উৎসাহ, লেখক হয়ে ওঠার সমর্থন বা যদি বলি রসদ— এসবের সূত্র বা উৎস জানতে চাই।

তপন বাগচী : লিখি বলেই লেখক। ব্যাকরণ তাই বলে। আসলেই কি লেখক হয়েছি? আমি এখনও দ্বিধান্বিত! আমার পরিপার্শ্বই আমাকে লেখক বানিয়েছে। আমি মূলত পাঠক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে স্কুলপাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়েছি। মামাবাড়িতে থাকতাম। ছোটমামা রঞ্জিতকুমার বর বই পড়তেন। মায়ের বাবা, মানে দাদু রসিকলাল বর প্রচুর পড়তেন। ওই বয়সেই জসীমউদ্‌দীনের ছড়া পড়েছি। রবীন্দ্রনাথের ছড়া পড়েছি। ক্লাস সেভেনে পড়ার বয়সেই। না বুঝলওে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র’ পড়া হয়ে গেছে। কিন্তু লেখার কথা মনে হয়নি। পিতার প্রেরণায় ও চাপে কবিতা লিখতে হয়েছে। এরপর দেখলাম মনের কথা প্রকাশের এ এক অবরাতি সুযোগ। কেবল নিজের মনের কথা নয়, সকলের মনের কথাকে নিজের কথা মনে করেও লেখা হয়ে যায়। সমাজের কথা বলতে পারি এই লেখার মাধ্যমে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সামিল হয়েছিলাম ছড়া ও কবিতা নিয়ে। এখন ফোকলোরচর্চা করি শেকড়ের ইতিহাস জানতে ও জানাতে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করছি দেশের গৌরবময় ইতিহাসের কথা জানতে ও জানাতে। এখন লেখাই আমার নিয়তি। না লিখে আর উপায় নেই।

মেহেদী হাসান শোয়েব : আপনি তো শিশুসাহিত্যিক, লোকগবেষক, কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক। সাংবাদিকতায় পড়েছেন, করেছেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় আপনার বিচরণ। কোন পরিচয়ে আপনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

তপন বাগচী : কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর চালাতে গিয়ে শিশুসাহিত্য রচনা করেছি। শুরু করেছিলাম কবিতা রচনার মাধ্যমে। এরপর প্রিয় কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর অকাল প্রয়াণে মর্মাহত হয়ে তাঁর জীবনী লিখেছি। ম্যাসলাইন মিডিয়া সেন্টারে (এমএমসি) কাজ করতে গিয়ে তৃণমূলের সাংবাদিকতা গবেষণা করেছি। পিএইচডি করার সময় বেছে নিয়েছি বাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাগান নিয়ে। তখন থেকে আমার প্রাতিষ্ঠানিক ফোকলোরচর্চার শুরু। সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি। কিন্তু সকল পরিচয়কেই আমার নিজের পরিচয় মনে করি। যেহেতু কাজ করেছি, তাই পরিচয় দ্বিধা করি না। তবে ভেতরে ভেতরে কবিতার অনুভবকেই লালন করি। একটি কবিতা লিখতে পেরে যে তৃপ্তি পাই, তা অন্য মাধ্যমে পাই না।

মেহেদী হাসান শোয়েব : আপনার সাহিত্যকর্মের উপর গবেষণা করেছেন ভারতের গবেষক। এ বিষয়ে জানতে চাই।

তপন বাগচী : ভারতের গবেষণার আগে বাংলাদেশেই গবেষণা করেছেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী দোলা বসু গবেষণা করেছেন আমার মরমি গান নিয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের প্রফেসর ড. অনুপম হীরা মণ্ডল আমার সাহিত্য নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। কুমিল্লা সমবায় একাডেমির তৎকালীন উপাধ্যক্ষ ও বর্তমানে সরকারের উপসচিব হরিদাস ঠাকুর আমার কবিতা নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। এছাড়া খুলনার মুর্শিদা আহমেদ ও ঢাকার ড. আখতরুজ্জাহান আমার সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাদের গ্রন্থ এখনো অপ্রকাশিত। আর ভারতের নদিয়ার বিশিষ্ট গবেষক শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ আমার শিশুসাহিত্য নিয়ে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. তরুণ মুখোপাধ্যায় আমার কবিতা নিয়ে, কবি-সাংবাদিক নরেশমণ্ডল এবং দিল্লির মনীষা কর বাগচী আমার কবিতা নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. অমিতাভ বিশ্বাস আমার মরমিগানের সংকলন করেছেন। কলকাতা বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজের অধ্যাপক ড. স্বাতী রায়চৌধুরী আমার ৪০টি কবিতা অনুবাদ করেছেন। আরও অনেক গবেষক আমার সাহিত্য নিয়ে গবেষণার আগ্রহ দেখিয়েছেন। বারান্তরে সেই তথ্য জানা যাবে।

মেহেদী হাসান শোয়েব : আপনার সাহিত্যিক জীবনকে কেমন উপভোগ করেন? এ জীবনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা বলুন।

তপন বাগচী : সাহিত্যিক জীবন ভোগের নয়, ত্যাগের। এবং আনন্দ বেশি সেই ত্যাগেই। এই সাহিত্য করতে গিয়ে শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়েছে। বিদেশে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার হাতছানি ত্যাগ করেছি। আমার বন্ধুরা ডাক্তার-ইঞ্জিয়ার আর আমি ছাপোষা কবি। পরিবার-পরিজনকে সময় দিতে পারিনি। সারাদেশের ঘুরে বেড়িয়েছি ঘরে সময় না দিয়ে। এইসব ত্যাগের ঘটনাই আমাকে লিখতে রসদ জুগিয়েছে। আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি? হিসেবে করিনি। নিন্দা যতটুকু জুটেছে, ভালবাসা পেয়েছি তার চেয়ে বেশি।

মেহেদী হাসান শোয়েব : সাহিত্যিক হওয়ার জন্য কখনও কি আফসোস হয়?

তপন বাগচী : আফসোস হবে কেন? সাহিত্যিক হয়েছি বলে গর্ব হয়। একজন ক্ষুদ্র সেবক হিসেবে বাংলা সাহিত্যের সেবা করতে পারছি, এর মাধ্যমে দেশের সেবা করতে পারছি, একজীবনে এইটুকু বা কম কীসের?

মেহেদী হাসান শোয়েব : আপনার নিন্দুকদের জন্য কী বলবেন?

তপন বাগচী : নিন্দুকেরা আমার পরম বন্ধুর মতো কাজ করছে। তারা আছে বলেই আমাকে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। আর এইটুকু বুঝি যে নিন্দুকেরা শক্তিশালী হলেও তারা পরাজিতের বংশধর।

মেহেদী হাসান শোয়েব : লিখতে চান, অথচ এখনও লেখা হয়নি কী?

তপন বাগচী : প্রকৃত লেখার মতো কিছুই লেখা হয়নি এখনো। একটা ভাল কবিতা লেখার বড় লোভ হয়। আমাদের অবহেলিত জনগোষ্ঠী যেমন কায়পুত্র সম্প্রদায় নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার বড় সাধ হয়। জানি না, কখন সেই আশা পূর্ণ হবে।

মেহেদী হাসান শোয়েব : বইমেলা শুরু হয়েছে। আপনার এবছর বইমেলায় কী কী বই আসছে?

তপন বাগচী : দুটি ছড়ার বই, একটি কবিতার বই আছে নতুন। তিনটি প্রবন্ধের বইয়ের পুনর্মুদ্রণ আসছে। আর আমার লেখা কবিতা ও গানের কবিতা নিয়ে বের হচ্ছে ‘কবিতাসংগ্রহ’। বেশ কিছু সাক্ষাৎকার দিয়েছি, সেটি নিয়ে বের হবে ‘সাক্ষাৎকারসংগ্রহ’। হয়তো এই সাক্ষাৎকারটিও সেখানে থাকতে পারে।

মেহেদী হাসান শোয়েব : নতুন যারা লেখার জগতে আসছেন, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

তপন বাগচী : আমি তো আমাকেই নতুন লেখক ভাবি এখনো। পরামর্শ একটাই , প্রচুর পড়তে হবে। চিরকালীন লেখা যেমন পড়তে হবে, সমকালীন লেখাও পড়তে হবে। প্রতিটি লেখারই কিছু করণকৌশল আছে, সেগুলো রপ্ত করার আগে বই প্রকাশ করা ঠিক হবে না। বিষয় যা-ই হোক, নতুন করে ভাবতে হবে। আশা করি নতুনদের অবদানে আমাদের সাহিত্য ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠবে।

মেহেদী হাসান শোয়েব : রোজকার খবরের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক অভিনন্দ এবং শুভেচ্ছা জানাই। আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা। আপনার আরও সফলতা এবং সমৃদ্ধি প্রত্যাশা করি। আপনার সৃজনশীল কাজে দেশ ও মানুষ উপকৃত হোক। শুভ সময়।

বিষয়:
পরবর্তী খবর

মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস

রক্তের মূল্যে স্বাধীনতা

২.
মাজহারুল হক মন্টু। যশোরের ছাত্র রাজনীতির অঙ্গনে একটা পরিচিত নাম। স্নাতক শেষবর্ষের ছাত্র। স্কুলজীবন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ১৯৬৯ সালের স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে তার রয়েছে অনন্য সাধারণ ভূমিকা। তাছাড়াও ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে সক্রিয় প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে দলের ভেতরে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে তুলেছেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের পর ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আওয়ামী লীগের নানা টানাপোড়েন শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পূর্বে আহুত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর সারা বাংলাদেশের মতো যশোর শহরেও প্রবল গণআন্দোলন শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় যশোর শহরের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে এসে আন্দোলন শুরু করে। ৩ মার্চ ছাত্র-জনতার একটা মিছিল যশোর কালেক্টর ভবনে উড্ডীন পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা নামিয়ে একটা কালো পতাকা উত্তোলন করে যখন ফিরে আসছিল, তখন টিএন্ডটি ভবন থেকে পাকিস্তানি সেনারা গুলি বর্ষণ করলে চারুবালা নামে একজন গৃহবধূ নিহত হন। যার ফলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে থেকে বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে সারা বাংলাদেশের মতো যশোরেও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। তখন প্রতিদিনই শহরে চলতে থাকে প্রতিবাদ মিছিল, মিটিং।

২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে ছাত্রনেতা খান টিপু সুলতানের নেতৃত্বে যশোর শহরের নিয়াজ পার্কে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৫ মার্চের রাতের আঁধারে হানাদার খান সেনারা যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরে প্রবেশ করে রাস্তায় অবস্থানরত জনতার উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে অনেক সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। অন্যদিকে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই সারাদেশে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মাযহারুল হক মন্টু একজন ছাত্রনেতা হিসাবে যশোর শহরের আন্দোলনের প্রতিটা স্তরে যথাযথ ভূমিকা রাখার পাশাপশি শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু সাধারণ ৩০৩ রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করে আধৃুুনিক অস্ত্র সজ্জিত শত্রুসেনাদের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত হয়ে তার নেতৃত্বে একটা গেরিলা দল নিয়ে গত ৭ দিন আগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যশোর সদর থানার প্রত্যন্ত এলাকা কাশিমপুর গ্রামে সেল্টার গ্রহণ করেন। তিনি কলেজ পড়ুয়া একজন যুবক হলেও তাকে দেখে মনে হয় যেন একজন আর্মি অফিসার। কথাবার্তায় চালচলনে যেন আভিজাত্য ঝরে পড়ে। সামরিক বাহিনীতে সৈনিকদের যেমন কড়া আইন কানুনের মধ্যে থাকতে হয়, তেমনি তার অধীনের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের থাকতে হয় কঠোর আইন কানুনের মধ্যে। পান থেকে চুন খসলেই কারো রেহাই নেই। সেন্টি ডিউটি বা রেকি করা কোন কাজেই সামান্যতম অবহেলাও তার সহ্য হয় না।

সেই কড়া স্বভাবের মাজহারুল হক মন্টুকে আজ কিন্তু খুব প্রাণখোলা এবং খোশমেজাজে দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে অবশ্য একটা বড় কারণ আছে । তাহলো তার নেতৃত্বে আরও কয়েকটি গেরিলা দল মিলে আজ ভোর রাতে যশোর শহরের পূর্বের খাজুরা হাই স্কুল রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে বেশ কিছু রাজাকারকে হত্যা করে সফলতা দেখিয়েছে। অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের এই সফলতার পেছনে মোঃ ইসহাক নামের একজন সামরিক প্রশিক্ষপ্রাপ্ত মুজাহিদ সদস্যের অবদান সবচেয়ে বেশি। মুক্তিযোদ্ধা দলের সদস্য না হয়েও সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং খাজুরা রাজাকার ক্যাম্পের পাশের লেবুতলার গ্রামে বাড়ি হওয়ায় ক্যাম্পটির সেন্টি পোস্ট ও অন্যান্য অবস্থান সম্বন্ধে তার স্পষ্ট ধারণা ছিল। সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হওয়ায় যশোর অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে ইসহাক ইপিআর বাহিনীর সাথে প্রথম পর্যায়ের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সেই যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর প্রতিরোধ যোদ্ধারা ভারতে চলে গেলেও নতুন বিবাহিত স্ত্রী এবং পরিবারের অসুবিধার কথা ভেবে সে ভারতে যাওয়া থেকে বিরত ছিল। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করার পর সে আর ঘরে বসে থাকতে পারেনি। মাজহারুল হক মন্টুর গেরিলা দলটি কাশিমপুর গ্রামে সেল্টার গ্রহণ করার পর থেকেই সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে মন্টু সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে। তারর যোগ্যতা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার প্রচণ্ড আগ্রহ দেখে মন্টু সাহেব তাকে নিজ দলে অন্তভূক্ত করে নেন।

কাশিমপুর গ্রামে সেল্টার গ্রহণ করার পর থেকেই খাজুরা হাই স্কুল রাজাকার ক্যাম্পের নানা অপকর্মের কথা মন্টু সাহেবের কানে আসছিল। মাত্র ১০/১২ দিনের মধ্যে ২টি বাড়ি লুট এবং বেশ কয়েকজন নারীর সম্ভ্রমহানীর সাথে তাদের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় অন্যান্য গেরিলা কমান্ডারের সাথে আলোচনা করে মন্টু সাহেব খাজুরা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর একই এলাকায় বাড়ি, অবাধ যাতায়াতের সুযোগ এবং সামরিক বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হওয়ায় ক্যাম্পটি সরেজমিনে রেকি করে একটা খসড়া আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়ণের জন্য তিনি ইসহাককে দায়িত্ব প্রদান করেন। সেও সুযোগটি মনেপ্রাণে গ্রহণ করে। তারপর অবাধ যাতায়াতের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটা নিখুঁত আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সে তা মন্টু সাহেবের নিকট জমা দেয়। সেই আক্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে ৫ জন গেরিলা কমান্ডার আলোচনা করে সামান্য কিছু কাটছাট করে চুড়ান্ত করা হয়। তারপর মাযহারুল হক মন্টুর নেত্বত্বে ৫টা গেরিলা দলের ৫৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আজ ভোর তারা রাতে খাজুরা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে শতভাগ সফলতা লাভ করে। শুধু যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়নে সহযোগিতা নয়, ইসহাক অস্ত্র হাতে সরাসরি গুলিতে শত্রুর ২ জন সেন্টিকে হত্যা করে যুদ্ধ জয়ে অনেক ভূমিকা রেখেছে। তাইতো আজ সারাদিন ক্যাম্পে একটা আনন্দের আমেজ লেগে আছে। সাথে সাথে চলছে ইসহাক বন্দনা।

চলবে…

পরবর্তী খবর

মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস

রক্তের মূল্যে স্বাধীনতা

১৯৭১ সালের জুন মাসের শেষ দিক। বাংলাদেশে তখন চলছে পাকিস্তানি কসাই সেনাদের রক্তের হলিখেলা। ২৫শে মার্চের কাল রাত থেকে তারা সারা বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের উপর আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যার পাশাপাশি গ্রামের পর গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী ধর্ষণসহ নানা পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে মেতে উঠেছে। অন্য দিকে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা– ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ দেওয়ার পর থেকেই দেশে শুরু হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই সারা বাংলাদেশে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ যুদ্ধ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ই এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ এবং তার অল্প কিছু দিনের মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যগাথা শুনে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ যেমন উৎফুল্ল হয়ে উঠতো, তেমনি বাঙালি যুবকেরা মুুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে অনুপ্রেরণা খুঁজে পেত। যার ফলে দেশের ভেতর থেকে যুবক ছেলেরা দলে দলে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে শুরু করে।

দিনে দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে পাকি সেনারাও নতুন ফন্দি আঁটে। নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য স্বাধীনতাবিরোধী জামাতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামসহ অন্যান্য স্বাধীনতা বিরোধী দলের সহযোগিতায় তারা রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী গঠন-কাজে হাত দেয়। জুন মাসের প্রথম দিকে তাদের এই বাহিনী গঠন-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এই মাসের মাঝের দিকে জামাত নেতা লেবুতলা গ্রামের ইব্রাহিম ডাক্তারের নেতৃত্বে (হাতুরে ডাক্তার) যশোর শহর থেকে ২০ মাইল পূর্বে খাজুরা উচ্চ বিদ্যালয়ে একটা রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করার পর থেকেই তারা গ্রামের সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার, নির্যাতন, বাড়িঘর লুটপাট এবং নারী ধর্ষণের মতো গর্হিত কাজ শুরু করে দেয়। শুধু তাই না মাত্র ১০/১২ দিনের মধ্যেই লেবুতলা গ্রামের নিমাই কাপালি, গৌর মাষ্টারের বাড়িতে লুটপাট ও খাজুরার আলিয়র রহমানের স্ত্রী ও ২ বোনকে ধরে নিয়ে গিয়ে সম্ভ্রমহানী করার পর তারা এলাকায় মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়ে গেছে। এখন গাঁয়ের মানুষদের জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘের মতো অবস্থা। প্রতি রাতেই যেমন পাকিস্তানি কসাই সেনারা বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ চালাচ্ছে, তেমনি দিনের বেলায় রাজাকার ও আল বদরেরা গ্রামে গ্রামে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও নানা অসামাজিক কাজে মেতে উঠছে। শত্রুদের এই দ্বিমুখী আক্রমণে আজ বাংলাদেশের প্রতিটা এলাকায় নরকের যন্ত্রণা নেমে এসেছে। তাদের জীবন ও জীবিকা এলোমেলো হয়ে গেছে।

খান সেনাদের আক্রমণের আগাম খবর জানার জন্য এখন মানুষ তাদের রাতের ঘুমকে হারাম করে গাঁয়ে গাঁয়ে সারা রাত পাহারা বসিয়েছে। নির্ঘুম রাত কাটানোর পর দিনের বেলায় যে একটু শান্তিতে ঘুমাবে তারও কোন উপায় নেই। কারণ কখন যে রাজাকার আল বদরেরা হামলা করে বাড়ি ঘরে লুটপাট কিংবা যুবতি নারীদের অপহরণ করে নিয়ে যায় সেই চিন্তায় তাদের উৎকন্ঠিত থাকতে হয়। দিনের আলোয় তবুও মনে একটু বল পাওয়া যায়। কিন্তু রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে মানুষের জীবনও যেন ঘোর অন্ধকারে ছেয়ে যায়। তখন তাদের মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খায়– পরিবারের সবার জীবন রক্ষা করতে পারবো তো? বাড়ির যুবতি মা, বোন, কন্যার সম্ভ্রম রক্ষা করা যাবে তো? রাত যত গভীর হতে থাকে মানুষের মনের আতঙ্কও ততো বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরই মধ্যে এলাকায় জোর গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতরে প্রবেশ করেছে। কেউ তাদের চোখে দেখেনি। তবুও এই খবর শুনে সাধারণ মানুষ আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছে। এবার নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা তথা রাজাকার আলবদর বাহিনী পরাজিত হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। কিন্তু সেই স্বাধীনতার জন্য আর কত দিন আর কত রাত তাদের এমন দুঃসহ যাতনা ভোগ করতে হবে?

আজ ৩০শে জুন। জুন মাসের শেষ দিন। মানুষ জন সারা রাত গাঁ পাহারা দিয়ে ঘরে ফেরা শুরু করেছে। মসজিদে মসজিদে মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। ঠিক এমন সময় খাজুরিয়া রাজাকার ক্যাম্পের উপর যেন গুলির বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। এলএমজি, এসএলআর, ৩০৩ রাইফেলের গুলি ও গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দের পাশাপাশি মুর্হুমুহু ভেসে আসছে জয় বাংলা স্লোগান। তখন এলাকার মানুষের মনের সব সংশয় দূর হয়ে যায়। তারা নিশ্চিত হয়ে যায়, নরাধম রাজাকাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে মুক্তিযোদ্ধারাই খাজুরা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেছে। সারা ক্যাম্প এলাকায় যেন ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। সেই ভূমিকম্প যেন থামতেই চায় না। প্রায় ঘন্টা খানেক প্রবল গুলাগুলি চলার পর আস্তে আস্তে তা স্তিমিত হয়ে আসে। এরই মধ্যে পূর্ব আকাশে নতুন দিনের আশার সূর্য উদিত হতে দেখা যায়। দিনের আলোয় আশে পাশের বাড়িঘরের লোকজন ক্যাম্পের সামনে এসে দেখতে পায় ৫ জন রাজাকার মরে পড়ে আছে। বাকিরা জীবন বাঁচাতে ক্যাম্পের পিছনের ডোবায় আশ্রয় নিয়েছিল। মুক্তিবাহিনী চলে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে তারা ক্যাম্পে ফিরে আসছে। নরাধমদের এমন উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে দেখে গাঁয়ের লোকজন মনে মনে ভীষণ খুশি হলেও তারা মুখে তা প্রকাশ করতে পারে না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেদিনের রাতের খবরে যশোর জেলার খাজুরা রাজাকার ক্যাম্পের উপর মুক্তিযোদ্ধাদের সফল অপারেশন পরিচালনার খবর ফলাও করে প্রচার করার সাথে সাথে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বময়। এই খবর পেয়ে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিটা মুক্তিপাগল বাঙালির মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেদিনের চরমপত্র অনুষ্ঠানে শোনা গেল– বিচ্ছুদের গাবুড় মাইরের চোটে যশোরের খাজুরায় ৫ জন রাজাকার অক্কা পেয়েছে। বাকিরা জীবন বাঁচাতে ক্যাম্পের পেছনের ডোবার ভেতরে হাবুডুবু খেয়েছে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত