মিরপুর ৬০ ফিটে অনুষ্ঠিত হলো উদ্যোক্তাদের নিয়ে চা-আড্ডা। শুক্রবার (৩১ মে) বিকেলে উত্তর পীরেরবাগে আরশিনগর ও শিল্পপুরাণের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আড্ডায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী উদ্যোক্তাগণ মিলিত হয়েছিলেন।
শিল্পপুরাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারজানা জিতুর আমন্ত্রণে আড্ডায় উপস্থিত উদ্যোক্তাগণ তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করার পাশাপাশি নিজেদের ব্যবসা ও কার্যক্রমের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা, সমস্যা এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়েও আলোচনা করেন। এই আয়োজনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের উদ্যোগকে ডিজিটাল মাধ্যমের সহযোগিতা নিয়ে প্রসারিত করা এবং ডিজিটাল মাধ্যমের যথাযথ ব্যবহার বিষয়ে আইটি বিশেষজ্ঞের সাথে মত বিনিময় পর্ব।
অনানুষ্ঠানিক আবহের এই আয়োজনে উপস্থিত উদ্যোক্তাগণ পরস্পরকে সহযোগিতার মাধ্যমে আগামী দিনে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। তারা বলেন, এই আয়োজনের মাধ্যমে যে সূত্র স্থাপন হলো তার মাধ্যমে সবাই মিলে একসাথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

এরকম আড্ডা-আয়োজনের জন্য উদ্যোক্তাগণ ফারজানা জিতুকে ধন্যবাদ জানান এবং নিয়মিত এরকম আয়োজনের আহ্বান জানান।
করোনাকালের স্থবির দিনগুলো যেন অনেকের জীবন বদলে দিয়েছিল। কেউ হারিয়েছেন চাকরি, কেউ প্রিয়জন, কেউ বা হারিয়েছেন জীবনের গতি। কিন্তু সেই থেমে যাওয়া সময়েই নতুনভাবে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন সুলতানা মুক্তা। দীর্ঘ ১৭ বছরের শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে তিনি তৈরি করেছেন নিজের স্বপ্নের প্ল্যাটফর্ম — ‘ঋক্ষশৈলী’।
রোজকার খবরের বিশেষ প্রতিনিধি ফারজানা জিতুর কাছে সুলতানা মুক্তা তুলে ধরেন তার ‘ঋক্ষশৈলী’র গল্প, সংগ্রাম আর স্বপ্নের কথা। উদ্যোক্তাদের জীবন ও ভাবনা নিয়ে শিল্পপুরাণ ও আরশিনগরের সৌজন্যে রোজকার খবরের নিয়মিত আয়োজনের অংশ হিসেবে আজ প্রকাশিত হল এই বিশেষ প্রতিবেদন।
‘ঋক্ষশৈলী’ মূলত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নিয়ে মেলা আয়োজনের একটি সংগঠন। ছোট ছোট ব্যবসায়ী, ঘরোয়া নারী উদ্যোক্তা, হাতে বানানো পণ্যের কারিগর— সবাইকে এক ছাতার নিচে এনে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর জায়গা তৈরি করেছে মুক্তার এই উদ্যোগ।
‘আমি শিক্ষকতা করতাম অনেক দিন। ২০২০ সালে চাকরি ছেড়ে দিই। মনে হচ্ছিল, জীবনে কিছু একটা নিজের মতো করে করতে চাই,’— বলছিলেন মুক্তা। ‘সেই সময় অনলাইনে Tuna-Tunyy নামে একটি বুটিক পেজ খুলি। উদ্দেশ্য ছিল ব্যস্ত থাকা, কিন্তু ধীরে ধীরে কাজটাই ভালোবাসায় পরিণত হলো।’
ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হওয়া— সেই স্বপ্ন তিনি পূরণও করেছেন। কিন্তু উদ্যোক্তা জীবনের এই অধ্যায় যেন মুক্তার জীবনের দ্বিতীয় প্রেরণা। ‘শিক্ষকতা আমাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে, আর উদ্যোক্তা জীবন দিয়েছে নিজেকে নতুনভাবে গড়ার সুযোগ,’— বললেন তিনি।
শুরুতে পরিবার থেকেই এসেছিল শঙ্কা, সন্দেহ আর কিছু নিরুৎসাহ। “পরিবার বলত— ‘তোমাকে দিয়ে হবে না।’ তখন ভাবতাম, কেন পারব না?”— স্মৃতি হাতড়ে বললেন মুক্তা। ধীরে ধীরে সেই অবিশ্বাসই হয়ে উঠেছে তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি।
তবে মুক্তার গল্প একা লড়াইয়ের নয়— বরং একসঙ্গে এগিয়ে চলার গল্প। ২০২২ সালে অনলাইনে পরিচিত চারজন বন্ধু মিলে প্রথমবারের মতো একটি মেলার আয়োজন করেন তারা। নাম দেন ‘ঋক্ষশৈলী’। প্রথম আয়োজনেই মেলে অভাবনীয় সাড়া। ‘সেই মেলাতেই বুঝলাম— একা নয়, একসঙ্গে কাজ করলেই সফলতা সম্ভব,’ বলেন মুক্তা।
এখন পর্যন্ত ১৭টি মেলা আয়োজন করেছে ঋক্ষশৈলী। প্রতিটি মেলাতেই সুযোগ পেয়েছেন নতুন নতুন উদ্যোক্তারা, যারা হয়তো কখনও দোকানের বাইরে নিজেদের পণ্য দেখানোর সাহস পাননি। মুক্তা বলেন, ‘আমরা এমন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিই, যারা শুরু করছেন একদম নতুন করে। তাদের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের উদ্দেশ্য।’
তবে সহজ ছিল না এই যাত্রা। সংসার, সন্তান, ঘর সামলে উদ্যোক্তা জীবনে সময় দেওয়া— শুরুতে ছিল অসম্ভব কঠিন। মুক্তা বলেন, ‘মেয়েদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ঘর সামলে নিজের জন্য সময় বের করা। ধীরে ধীরে পরিবার বুঝেছে, আমিও ব্যালান্স করতে শিখেছি।’
ব্যর্থতাও এসেছে পথে। মূলধনের অভাব, পণ্য সংগ্রহে সমস্যা, অনলাইন পেজের প্রচার না পাওয়া— সবই পেরিয়ে আজ তিনি আত্মবিশ্বাসী উদ্যোক্তা। তার মতে, ‘সফল হতে গেলে বারবার পড়তে হবে, আবার উঠতেও হবে। জানার শেষ নেই, শেখার শেষ নেই। এই মানসিক প্রস্তুতিটাই বড়।’

পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পেছনে ঘুরতে থাকা তরুণদের তিনি উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘উদ্যোক্তা হলে শুধু নিজের জীবিকার পথ তৈরি হয় না, আরও কয়েকজনের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়। এখন অনেক তরুণ পড়াশোনার পাশাপাশি উদ্যোগ নিচ্ছে— এটা ভালো লক্ষণ।’
নতুনদের জন্য তার পরামর্শ, ‘ধৈর্য ধরতে হবে। কেউ একদিনে সফল হয় না। মানসিকভাবে শক্ত থাকতে হবে। নিজের কাজের বিষয়ে জানতে হবে সব কিছু এবং কখনও হাল ছাড়া যাবে না।’
ঋক্ষশৈলীর সাফল্যের পেছনে মুক্তা ও তার দলের যে নিষ্ঠা, তা এখন অনেক নতুন উদ্যোক্তার অনুপ্রেরণা। মুক্তা বলেন, “আমরা ৬৪ জেলায় কাজ করতে চাই। আমাদের লক্ষ্য, বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সুযোগ তৈরি করা। আর একদিন আমরা যেন দেশের বাইরেও ‘মেড ইন বাংলাদেশ’-্এর গর্ব ছড়িয়ে দিতে পারি।”
সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা নিয়েও তিনি সচেতন। বলেন, ‘আমরা শুধু ব্যবসা নয়, কর্মসংস্থান তৈরি করতে চাই। যেন দেশের তরুণ-তরুণীরা কাজের সুযোগ পায়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।’
শেষে তিনি বললেন একটাই কথা— ‘কোনো কাজেই হাল ছাড়া যাবে না। মনে রাখতে হবে— আমি পারি, আমি পারব, আমাকে পারতেই হবে।’
ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। পরিবারও চেয়েছিল ছেলেটা সরকারি চাকরি করুক, সমাজে প্রতিষ্ঠা পাক। কিন্তু শরিফ আহমেদ পাপ্পু পরে ভাবলেন— চাকরির সামান্য বেতনে হয়তো নিজের সংসার চলবে, কিন্তু সমাজ বদলাবে না। তাই একসময় নিজের ভেতরে প্রশ্ন জাগল, ‘আমি কি আর সবার মতো চাকরির পেছনে ছুটব, নাকি অন্যের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করব?’ সেই প্রশ্নের উত্তরই তাকে বানিয়েছে উদ্যোক্তা।
রোজকার খবরের বিশেষ প্রতিনিধি ফারজানা জিতুর কাছে শরিফ আহমেদ পাপ্পু তুলে ধরেন তার মাস্টার ফ্যাশন প্রতিষ্ঠার গল্প, সংগ্রাম আর স্বপ্নের কথা। উদ্যোক্তাদের জীবন ও ভাবনা নিয়ে শিল্পপুরাণ ও আরশিনগরের সৌজন্যে রোজকার খবরের নিয়মিত আয়োজনের অংশ হিসেবে আজ প্রকাশিত হল এই বিশেষ প্রতিবেদন।
‘আমি দেশের মানুষকে সেবা করার জন্যও, বাংলাদেশের বেকারত্ব দূর করার জন্যও উদ্যোক্তা হয়েছি,’— বলেন উদ্যোক্তা পাপ্পু। তার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিশে আছে তৃপ্তি ও সংগ্রামের গল্প।
শুরুটা ছিল একেবারেই একা। পরিবার তখনও বিশ্বাস করত না, পাপ্পুর পক্ষে কিছু করা সম্ভব। “তারা বলত, ‘তুই পারবি না।’ কিন্তু সেই কথাই আমার চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। আমি প্রমাণ করতে চেয়েছি, পারব, অবশ্যই পারব,” বলেন তিনি।

পাপ্পুর উদ্যোক্তা জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন ‘নিজের বলার মতো গল্প’ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার জাহিদ। সেই ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণেই তিনি শিখেছেন কিভাবে হতাশা জয় করতে হয়, ব্যর্থতা থেকে নতুনভাবে দাঁড়াতে হয়, আর নিজের ব্যবসাকে উন্নতির পথে নিতে হয়।
তবে সাফল্যের আগে ছিল ব্যর্থতার দীর্ঘ অধ্যায়। প্রথম ব্যবসায় ভুল করেছিলেন পণ্য নির্বাচনে। ‘ঢাকার চকবাজার থেকে প্রোডাক্ট কিনে বিক্রির চেষ্টা করি। পরে দেখি, মান ভালো না। তখন নিজেকে প্রশ্ন করলাম— আমি কি টাকা দিয়ে খারাপ পণ্য কিনব? উত্তর ছিল না।’
এরপর আবার নতুন করে শুরু করেন। এবার পণ্যের গুণমান, বাজারের চাহিদা, গ্রাহকের রুচি— সব কিছু নিয়েই গবেষণা শুরু। নিজে থেকেই শিখেছেন মার্কেটিং, সেলস, ও ব্র্যান্ডিং। বলেন, ‘আমি তখন বুঝলাম, আগে শিখতে হবে। না জেনে ঝাঁপ দিলে আবারও হারব।’
‘মাস্টার ফ্যাশন’ এখন তার গর্বের নাম। যদিও এখনও বড় প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেনি, কিন্তু পাপ্পুর চোখে এর ভবিষ্যৎ স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘আমি চাই, আমার প্রতিষ্ঠান একদিন বড় গার্মেন্টস হোক— যেখানে অন্তত ১০ হাজার মানুষ কাজ করবে।’

তবে শুধু ব্যবসা নয়, সমাজকর্মও তার নিয়মিত কাজের অংশ। নিজের এলাকায় তিনি গাছ লাগান, ভাঙা রাস্তা মেরামত করেন, আর তরুণদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ দেন। ‘আমি চাই তরুণেরা চাকরির পিছনে না ঘুরে নিজের কাজ শুরু করুক। উদ্যোক্তা হলে শুধু নিজের রিজিক হয় না, আরও কয়েকটা পরিবারের রিজিকের ব্যবস্থা হয়,’ বলেন পাপ্পু।
নতুনদের জন্য তার পরামর্শ— স্টুডেন্ট লাইফ থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘স্কিল শেখো, কথা বলার অভ্যাস গড়ো, যোগাযোগ বাড়াও, প্রেজেন্টেশন স্কিল উন্নত করো। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটখাটো উদ্যোগ নাও। তখন রিস্কও কম, শেখার সুযোগও বেশি।’

স্বপ্নের পথে এই লড়াই আজও চলছে। নিজের অবস্থান থেকে তিনি বিশ্বাস করেন, উদ্যোক্তারাই বেকারত্ব ঘুচাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছেন। আর এই বিশ্বাসেই এগিয়ে যাচ্ছেন শরিফ আহমেদ পাপ্পু, এক হাতে ব্যবসা, অন্য হাতে সমাজ পরিবর্তনের কাজ নিয়ে।
‘বাংলাদেশকে উন্নত করতে আমি আমার সর্বোচ্চটা দিতে চাই,’— বললেন তিনি, মনে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি নিয়ে।