[নজরুলকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি ঘোষণার যৌক্তিকতা কিংবা অদ্যাবধি এ বিষয়ে কোনো সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে কি হয়নি, সমালোচক বিশেষের তোলা এসব বিতর্কে না গিয়ে, এমনকি “বাংলাদেশী” জাতীয়তার অর্থে নয় — বৃহত্তর বাঙালিত্বের ধারণা থেকেই, তিনি কেন আমাদের ‘জাতীয় কবি’, সেটাই লেখক সংক্ষেপে এ প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনাকে আমরা স্বাগত জানাবো।]
সুভাষচন্দ্র বসু ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার তৎকালীন এ্যালবার্ট হলে নজরুল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন : “আমরা যখন যুদ্ধে যাবো — তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাবো, তখনও তাঁর গান গাইবো।” নজরুল প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের এই উক্তিটি বহু-উদ্ধৃত। সুভাষচন্দ্র তাঁর ওই ভাষণে নজরুল সম্পর্কে একাধিকবার ‘জ্যান্ত মানুষ’ কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। এ কথার দ্বারা তিনি নজরুল প্রতিভার ‘প্রাণময়তা’র কথা বোঝাতে চেয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, “আমাদের প্রাণ নেই তাই আমরা এমন প্রাণময় কবিতা লিখতে পারি না।” তাঁর মতে সাহিত্যে জীবনকে, যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাকে নজরুলের মতো করে অন্তত তখন পর্যন্ত এদেশে আর কেউই প্রতিফলিত করতে পারেননি। এই না-পারার কারণ, সুভাষচন্দ্র বলেছেন, দেশের পরাধীনতা। তার মানে কথাটা দাঁড়াচ্ছে, পরাধীন দেশেও নজরুল ছিলেন একজন মুক্তপ্রাণ মানুষ। সাহিত্যে জীবনের এই প্রতিফলন, প্রাণের এই স্পর্শের কারণেই নজরুলের লেখার প্রভাব হয়েছে ‘অসাধারণ’। আর তা এতই অসাধারণ যে, সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, “তাঁর গান পড়ে আমার মতো বেরসিক লোকেরও জেলে বসে গাইবার ইচ্ছা হতো।” নজরুলের ‘দুর্গম গিরি’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে অভিহিত করে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, “আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই। প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সংগীত শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মতো প্রাণ-মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না।” তবে উক্ত ভাষণ সুভাষচন্দ্র শেষ করেছিলেন খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটি মন্তব্য দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, নজরুলের স্বপ্নটা ‘সমগ্র বাঙালি জাতির স্বপ্ন’। (মান্নান : ৫৪) এ কথার দ্বারা সুভাষচন্দ্র অনেকদিন আগেই বাঙালির জাতীয় কবি হিসেবে নজরুলের প্রতি স্বীকৃতি ঘোষণা করে গেছেন। বলা বাহুল্য হিন্দু-মুসলমান উভয় সংস্কৃতির উপাদানে গঠিত যে বাঙালিত্ব, সে অর্থেই নজরুলকে ‘সমগ্র বাঙালি জাতি’র স্বপ্নদ্রষ্টা বলেছিলেন তিনি।
অন্যদিকে বাঙলার আরেক বিশিষ্ট নেতা বিপিনচন্দ্র পাল, যিনি ছিলেন প্রচণ্ড রকমে রবীন্দ্রবিরোধী, চিত্তরঞ্জন দাশের নারায়ণ পত্রিকায় রবীন্দ্রবিরোধী প্রচারণার ক্ষেত্রে যাঁর ছিল বলতে গেলে কাণ্ডারির ভূমিকা, রবীন্দ্রসাহিত্যের ব্যাপারে যাঁর একটা বড় অভিযোগ ছিল যে দেশের মাটির সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই, নজরুলের কবিতায় তিনি মাটির গন্ধ খুঁজে পেয়েছিলেন; বলেছিলেন, “এ খাঁটি মাটি হইতে উঠিয়াছে”। আর এ-প্রসঙ্গে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, কিছুটা অশোভনভাবেই তাঁর ঠাকুরদাকে অবধি টেনে এনে বঙ্গবাণী পত্রিকায় (১৮ জুন ১৯২৩) বিপিন পাল লিখেছিলেন, “আগেকার কবি যাঁহারা ছিলেন তাঁহারা দোতলা প্রাসাদে থাকিয়া কবিতা লিখিতেন। রবীন্দ্রনাথ দোতলা হইতে নামেন নাই। কর্দমময় পিচ্ছিল পথের উপর পা পড়িলে কেবল তিনি নন, দ্বারকানাথ ঠাকুর পর্যন্ত শিহরিয়া উঠিতেন।” নজরুলকে বিপিন পাল ‘নতুন যুগের কবি’ এবং তাঁর কবিতায় ‘দেশে যে নতুন ভাব জন্মেছে তার সুর’ পাওয়ার কথা বলেছিলেন। (মান্নান : ৫৫)
আর প্রফুল্লচন্দ্র রায় পূর্বোক্ত এ্যালবার্ট হলের সংবর্ধনা সভায়ই তাঁর সভাপতির ভাষণে নজরুলকে ‘প্রতিভাবান মৌলিক কবি’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছিলেন, “তিনি বাংলার কবি, বাঙালির কবি।” এবং “কারাগারে শৃংখল পরিয়া বুকের রক্ত দিয়া তিনি যাহা লিখিয়াছেন তাহা বাঙালির প্রাণে এক নতুন স্পন্দন জাগাইয়া তুলিয়াছে।” প্রফুলচন্দ্র রায় এ প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের আওতায় নজরুলের প্রতিভা পরিপুষ্ট হয় নাই। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁহাকে কবি বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন।” (মান্নান : ৫৩) বস্তুত রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে কেবল কবি বলে স্বীকারই করেননি, (পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় যদি ভুলভাবে উদ্ধৃত করে না থাকেন), তাঁর রচনাকে এমন কি ‘মহাকাব্য’ বলেও অভিহিত করেছিলেন। নজরুল-প্রতিভা সম্পর্কে আপন ভক্ত-অনুরাগী মহলের ‘কিছু সন্দেহ’র জবাব দিতে গিয়ে তিনি যা বলেছিলেন তা এ-প্রসঙ্গে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য :
“… নজরুলকে আমি ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গপত্রে তাকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করেছি। জানি, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারোনি। আমার বিশ্বাস, তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও রূপ ও রসের সন্ধান করোনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।”
নজরুলের কবিতায় সমসাময়িকতার প্রভাব ও/বা তার চড়া সুর (নিশ্চয় নজরুলের সব কবিতা সম্পর্কে কথাটা প্রযোজ্য নয়) যাঁদেরকে তাঁর রচনার কাব্যমূল্য বা স্থায়িত্ব সম্পর্কে সন্দিহান রেখেছিল তাঁদের সে সন্দেহ বা অভিযোগ নাকচ করে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন :
“কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এসব তোমাদের অবদার বটে। সমগ্র জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করবে বৈকি! আমি যদি আজ তরুণ হতাম তাহলে আমার কলমেও ঐ সুর বাজত।” (মান্নান : ৫১)
২.
জীবনানন্দ দাশ, অনেকেরই বিচারে রবীন্দ্রপরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠতম প্রতিভা যিনি, নিজে অভিহিত হয়েছেন কখনো ‘নির্জনতম’ আবার কখনো ‘শুদ্ধতম’ কবি হিসেবে, নজরুলের কবিতা সম্পর্কে যাঁর মূল্যায়ন ‘চমৎকার কিন্তু মানোত্তীর্ণ নয়’, তিনিও নজরুলের কাব্য-সাধনার ‘অসার্থকতা’র জন্য যতটা না তাঁর প্রতিভার বৈশিষ্ট্যকে তার চেয়ে বেশি যুগ-পরিবেশকে, জনরুচির ‘অনুত্তীর্ণত’াকে দায়ী করেছেন। তাঁর ‘নজরুল ইসলাম’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করা যাক :
“জনগণ তখন আজকের মত ঈষৎ উন্নত কিংবা রূপান্তরিত? [য.প্রা.] — ছিল না; চমৎকার কবিতা চাচ্ছিল, (আজো জনমানস রকমফেরে তাই-ই চায় যদিও); নজরুল সেই মন স্পর্শ করতে পেরেছিলেন এমনভাবে যে আজকের কারও কোনো জনসাধারণের জন্যে তৈরী কবিতা বা গদ্যকবিতা ফলত পদ্যের স্তরে নেমেও তা পেরেছে কিনা বলা কঠিন। তখনকার দিনে বাংলায় লোকোত্তর পুরুষ কম ছিলেন না — শ্মশানের পথে সন্তানোৎসব জমেছিল বেশ খানিকটা ঔদাত্ত্যে। নজরুল ইসলামের আগ্রহ পুষ্ট হয়েছিল, তিনি অনেক সফল কবিতা উৎসারিত করতে পেরেছিলেন। কোনো-কোনো কবিতায় এতো বেশি সফলতা যে কঠিন সমালোচকও বলতে পারেন যে নজরুলী সাধনা এইখানে-এইখানে সার্থক হয়েছে; — কিন্তু তবুও মহৎ মান এড়িয়ে গিয়েছে। কোনো এক যুগে মহৎ কবিতা বেশি লেখা হয় না। কিন্তু যে বিশেষ সময়ধর্ম, ব্যক্তিক আগ্রহ ও একান্ততার জন্যে নজরুলের অনেক কবিতা সফল ও কোনো-কোনো কবিতা সার্থক হয়েছিল — জ্ঞানে ও অভিজ্ঞতায় মূল্য-ও-মাত্রা-চেতনায় খানিকটা সুস্থির হয়েও আজকের দিনের অনেক কবিতাই যে সে তুলনায় ব্যাহত হয়ে যাচ্ছে তা শুধু আধুনিক বিমুখ সময়রূপের জন্যেই নয় — আমাদের হৃদয়ও আমাদের বিরূপাচার করে, অনেক সময়ই আমাদের মনও আমাদের নিজেদের নয়; এই সাময়িকতার নিয়মই হয়তো তাই। কিন্তু ব্যক্তিকতা নজরুলের ও সময় এই বুদ্ধিসর্বস্বতার হাত থেকে তাঁকে নিস্তার দিয়েছিল।” (ফয়জুল : ১০৩)
উদ্ধৃতিটা বেশ দীর্ঘ হয়ে গেল। কারণ এর অভাবে জীবনানন্দের বক্তব্যের মর্মার্থ উপলব্ধিতে আমাদের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা। আমরা জানি কাব্য বিচারে জীবনানন্দের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় শুদ্ধতাবাদীর। কবিতায় মানুষ বা সমাজের প্রতি দায়বোধ কিংবা তাঁর নিজের ভাষায় ‘চিন্তা ও সিদ্ধান্ত, প্রশ্ন ও মতবাদ’ তাঁর মতে ততটা পর্যন্ত অনুমোদনযোগ্য যতক্ষণ তা ‘সুন্দরীর কটাক্ষের পিছনে শিরা, উপশিরা ও রক্তের কণিকার মতো লুকিয়ে থাকে’। (’কবিতার কথা’) নজরুলকে তিনি যে কোথাও কোথাও সফল এমন কি সার্থক ভেবেও চূড়ান্ত বিচারে অসার্থক বিবেচনা করেছেন সে তাঁর কাব্য বিচারের ওই মানদণ্ড থেকেই। এবং হয়তো নজরুলের কাব্যসাধনার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় লাভের সুযোগ ছাড়াই।১ নজরুলকে তিনি শেষাবধি বাংলা কাব্যের আবহমান ধারায় লালিত, বিশেষ করে রবীন্দ্র ঐতিহ্যের ‘আবহপুষ্ট’ ও ‘সেই পরিমণ্ডলেরই অন্তর্লীন একজন কবি’ হিসেবে দেখেছেন, যিনি ‘যেখানে-যেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতিকে অতিক্রম করেছেন’ সেখানেও ‘এমন কোনো নতুন সূচনালোকে পৌছুতে পারেন নি, যার থেকে সত্যিই একটা স্বতন্ত্র ঐতিহ্য (কবিতার) সৃষ্টি হতে পারে’। ‘আধুনিকতা’, ‘বৈদগ্ধ্য’, কাব্যবোধ বা রুচি ইত্যাদি সম্পর্কে যুদ্ধোত্তর পশ্চিমী ধারণাকে প্রায় স্বতঃসিদ্ধজ্ঞানে গ্রহণ করার ফলেই এলিয়ট ও ইয়েটসের সঙ্গে নজরুলের ‘আশ্চর্য আবশ্যিক পার্থক্য’ জীবনানন্দকে নজরুলের কবিতা সম্পর্কে কতিপয় নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্ররোচিত করেছে। তারপরও এ-প্রসঙ্গে জীবনানন্দের মন্তব্য : “কাজী নজরুল যদি ইউরোপীয় সাহিত্যের রীতি ও পরিণতির নিকট কোনো দিক দিয়ে ঋণী থাকেন, তা’হলে তা অনেকটা মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথের মধ্যস্থতায়। এ রকম পটভূমি বেছে নিতে হলে আধুনিকতর কবিদের শ্বাস আটকে আসত; কিন্তু নজরুল ইসলামের পক্ষে রবীন্দ্র-পরিস্রুত বিদেশী কাব্যেরও ততটা দরকার ছিল না — আধুনিক বাংলাদেশে তিনি বাংলার মাটিরই বিশেষ স্বায়ত্ত সন্তান বলে। আজকের বাংলার অন্য কোনো কবি সম্পর্কে এ-কথা বলা চলে না হয়তো। তাঁরা অনেকেই তাঁদের বিমুক্ত পরিব্রাজক সত্তাকে সংহত করেই বাঙালি।” (‘কবিতা পাঠ : দুজন কবি’) নজরুলের কবিতার স্থায়িত্ব বা মহত্ব নিয়ে তাঁর ঘোরতর সংশয়ী অবস্থান সত্ত্বেও জীবনানন্দ তাঁর বক্তব্য শেষ করেছেন এই স্বীকৃতি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে :
“বাংলার এ মাটির থেকে জেগে, এ মৃত্তিকাকে সত্যিই ভালোবেসে আমাদের দেশে উনিশ শতকের ইতিহাসপ্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়তাবাদী কবি নজরুল ইসলাম। তাঁর জনপ্রেম, দেশপ্রেম, পূর্বোক্ত শতাব্দীর বৃহৎ ধারার সঙ্গে সত্যিই একাত্ম। পরবর্তী কবিরা এ সৌভাগ্য থেকে অনেকটা বঞ্চিত বলে আজ পর্যন্ত নজরুলকেই সত্যিকারের দেশ ও দেশীয়দের বন্ধু কবি বলে জনসাধারণ চিনে নেবে। জন ও জনতার বন্ধু ও দেশপ্রেমিক কবি নজরুল।” (ফয়জুল : ১০৯)
বুদ্ধদেব বসু, বাংলা আধুনিক কাব্য সমালোচক হিসেবে তাঁর স্থান নিঃসন্দেহে শীর্ষে, তো প্রায় কিশোর বয়সে প্রথমে মাসিকপত্রে ছাপার অক্ষরে ‘বিদ্রোহী’ এবং তারপর ‘নোয়াখালির রাক্ষসী নদীর আগাছা-কণ্টকিত কর্দমাক্ত’ পাড়ে বসে কলকাতা-আগত এক মুসলমান যুবকের খাতায় কপি করা নজরুলের ‘আরো অনেকগুলি’ কবিতা পড়ে তাঁর সেই যে বিস্ময়-বিমুগ্ধতা তা তিনি পরে কাটিয়ে উঠেছিলেন সত্যি। কিন্তু নির্মোহ দৃষ্টিতে নজরুল বিচার করতে গিয়ে তিনি এ-পর্যায়ে যা লিখেছেন তা-ও যেন ভারসাম্যহীন ও আগাগোড়া স্ববিরোধিতায় পূর্ণ। নজরুলের প্রভাব তাঁর সময়ে ‘বোধহয় রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল’২ এবং ‘নজরুল সম্বন্ধে বিশেষভাবে বলবার কথা এইটেই যে তিনি একই সঙ্গে লোকপ্রিয় কবি ও ভালো কবি’ ইত্যাকার বাক্যের পাশেই কিংবা তার কিছু পরেই আবার তাঁর মন্তব্য : ‘একটি দুটি স্নিগ্ধ কোমল কবিতা ছাড়া [নজরুলের] প্রায় সবই ভাবালুতায় আবিল, অনর্গল অবচেতন বাক্যবিন্যাসে প্রায় অর্থহীন’। কখনো কিপলিংয়ের সঙ্গে (‘কোলাহলকে গানে বাঁধা’, লেখায় ‘শুধুই হৈ-চৈ আছে, কবিত্ব নেই’) আবার কখনো বায়রনের সঙ্গে (‘… সেই উচ্ছৃঙ্খলতা, আতিশয্য, শৈথিল্য, সেই রসের ক্ষীণতা, রূপের হীনতা, রুচির স্খলন’) নজরুলের প্রতিভা বা কবিস্বভাবের সাদৃশ্য টেনে বুদ্ধদেব বসু যা বলতে চেয়েছেন তা হল, নজরুলের কাব্যসাধনায় ‘কোনো পরিণতির ইতিহাস পাওয়া যায় না’, বছরের পর বছর তিনি ‘একই রকম’ লিখে গেছেন, কখনো নিজেকে অতিক্রমের চেষ্টা করেননি। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উক্তি ধার করে বুদ্ধদেব আরও বলেছেন, নজরুলের প্রতিভা ‘ধনী, কিন্তু গৃহিণী নয়’। (বুদ্ধদেব : ৯০-৯১)
নজরুলের সমস্ত সৃষ্টির সারিতে তাঁর গানগুলিকেই বরং সবচেয়ে সার্থক ও স্থায়িত্বের দিক থেকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বলে বুদ্ধদেব বসুর মনে হয়েছে। আর এই গানের মধ্যে নজরুলের বীরত্বব্যঞ্জক বা স্বদেশপ্রেমমূলক গানগুলোকে তাঁর মনে হয়েছে সেরা (এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পরে ও ‘সম্ভবত দ্বিজেন্দ্রলালের উপরে’ নজরুলের স্থান নির্দেশ করেছেন বুদ্ধদেব বসু), ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’কে বলেছেন ‘উৎকর্ষের শিখরস্পর্শী’। বুলবুল ও চোখের চাতক-এর কিছু গান সম্পকের্ও তাঁর মšতব্য : ‘অনিন্দ্য বললে অত্যন্ত বেশি বলা হয় না’। কিন্তু এই বক্তব্যের অব্যবহিত পরেই আবার নজরুলের বাকি গানগুলো সম্পর্কে ‘দুরতিক্রম্য রুচির দোষে’র অভিযোগ তুলে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, “শুধু যদি এই দোষ না থাকতো, শুধু যদি তাঁর রুচি হ’তো পরিশীলিত, তাহলে তাঁর মধ্যে একজন মহৎ গীতিকারকে আমরা বরণ করতে পারতাম।” (বুদ্ধদেব : ৯১) তারপরও এই ‘অসার্থক’ কবি কিংবা মহৎ-গীতিকার হবার সম্ভাবনা নিয়েও হতে-না-পারা (!) নজরুল সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর রায় :
ক. … পঁচিশ বছর ধ’রে তিনি আমাদের যা দিয়েছেন, সেই তাঁর অজস্র কাব্য ও সংগীত বাঙালির মনে তাঁকে স্মরণীয় ক’রে রাখবে। (বুদ্ধদেব : ৮৯)
খ. ‘বিদ্রোহী’ কবি, ‘সাম্যবাদী’ কবি কিংবা ‘সর্বহারা’র কবি হিশেবে মহাকাল তাঁকে মনে রাখবে কিনা জানি না, কিন্তু কালের কণ্ঠে গানের যে মালা তিনি পরিয়েছেন, সে মালা ছোটো কিন্তু অক্ষয়। … শুধু বাংলা কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে তাঁর আসন নিঃসংশয়, কেননা তাঁর কবিতায় আছে সেই বেগ, যাকে দেখামাত্র কবিত্বশক্তি ব’লে চেনা যায়। (বুদ্ধদেব : ৯২)
৩.
আপন রচনার শিল্পসার্থকতা বা তার স্থায়িত্ব নিয়ে নজরুল কিন্ত মোটেও ভাবিত ছিলেন না। যুগের নকিব তিনি, ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় কৈফিয়তের সুরে যথার্থই বলেছেন :
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি !
কেহ বলে, তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে !
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী !
বলেছেন, ‘অমর কাব্য তোমরা লিখিও …’, এবং
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
৪.
‘পৃথিবীর কবি’ হিসেবে তাঁর ‘স্বরসাধনায় বহুতর ডাক না পৌঁছানো’র — ‘ফাঁক রয়ে যাবা’র কথা রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করে নিয়েছেন। ‘ঐকতান’ কবিতায় আপন ‘সুরের অপূর্ণতার নিন্দা’ মেনে নিয়ে বলেছেন, ‘আমার কবিতা, জানি আমি,/গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী’। সাহিত্যের আনন্দের ভোজে নিজে যা দিতে পারেননি এমন কি তার ‘খোঁজে থাকা’র কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রযুগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের সে অপূর্ণতা পূরণে নজরুলের ভূমিকাই যে প্রথম ও প্রধানতমের, এ সত্য অস্বীকার করবে, কার সাধ্যি?
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শেষ বাক্যগুলোর অনুসরণে আমরাও যেন বিশ্বাস করেছি, যবেতক ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে’ ধ্বনিত হবে, ‘অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ’ উদ্যত থাকবে, নজরুলের কবিতার আয়ু বা আবেদন আসলে ততদিনই। আশা আমরা নিশ্চয় করব, স্বপ্ন দেখব এক সুন্দর সুদিনের যেদিন নজরুলের কবিতা সত্যিসত্যিই তার লড়াকু আবেদন খুইয়ে বসবে। কিন্তু সেদিন কবে আসবে? আদৌ কখনো আসবে কি? এদেশে বা পৃথিবীর কোথাও এমন সমাজ কি কখনো কায়েম হবে যেখানে কোনো রকম শোষণ-বঞ্চনা, বৈষম্য-বিভেদ, অন্যায়-উৎপীড়ন থাকবে না; কায়েমি স্বার্থ নামক বিষয়টির চির অবসান ঘটবে? সে সম্ভাবনা কি অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে আজ আরও দূরপরাহত বলে মনে হচ্ছে না? এ কারণেও নজরুল আরও বহুদিন আমাদের যুদ্ধসঙ্গী, তাঁর কবিতা-গান আমাদের অপরিহার্য রণবাদ্য-রণসঙ্গীত।
৫.
রবীন্দ্রনাথের সব কবিতা যে তাঁর সময়েও সব পাঠকের ভালো লাগতো তা তো নয়। আর আজকের দিনে তাঁর অনেক কবিতাই হয়তো প্রকৃত কাব্যামোদীদেরও আগ্রহ কাড়তে ব্যর্থ হবে। ব্যক্তির কাব্যবোধ বা অনুভূতির কথা বাদ দিলে এক্ষেত্রে পরিবর্তিত যুগরুচিরও একটা ভূমিকা আছে। কবিতা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য সাহিত্যসৃষ্টির বেলায়ও একথা প্রযোজ্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে বাংলা কবিতায় যুগান্তর ঘটিয়েছেন, তাঁর নানা সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে অন্তত একশো বছর এগিয়ে দিয়ে গেছেন, বাঙালির চিন্তা ও মননে সুগভীর ও স্থায়ী একটা প্রভাব সৃষ্টি করেছেন, এটা তো ঐতিহাসিক সত্য। এ কারো স্বীকার বা অস্বীকারের অপেক্ষা রাখে না। অর্থাৎ, আমরা বলতে চাইছি, লেখক বা সাহিত্যিকের ভূমিকা কেবল সৌন্দর্য সৃষ্টির দিক থেকে নয়। কিংবা হয়তো তার মাধ্যমেও তাঁরা আসলে জাতির মননচর্চা তথা সামাজিক বিকাশে একটা ভূমিকা রাখেন। সে ভূমিকাটা ঐতিহাসিক। পৃথিবীর সব বড় কবি-লেখক-শিল্পী সম্পর্কেই কথাটা কমবেশি খাটে। নজরুলের আবির্ভাবের আগে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের ভূমিকা ছিল প্রায় অধমর্ণের। বাঙলার জনসংখ্যার অর্ধেক বা তার বেশি হয়েও তাঁরা জানতো বাংলা সাহিত্যের কাছে তাদের নেয়ার মতো যদি বা কিছু থাকে, দেয়ার বিশেষ কিছু নেই। এ ব্যাপারে নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কেও তারা ছিল সন্দিহান। বাঙালি মুসলমানের এই হীনম্মন্যতা দূর করে তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস সঞ্চারের ক্ষেত্রে যে-দুজনের ভূমিকা মুখ্য তাঁদের একজন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও অন্যজন কবি নজরুল ইসলাম। এর মধ্যে প্রথমজন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিদের দান সম্পর্কে তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্য উপস্থাপন ও দ্বিতীয়জন তাঁর মৌলিক কাব্যসৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের শরিকানা নিশ্চিত করেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বাঙালি মুসলমানের দান ও অধিকার যে গৌণ বা উপেক্ষা করবার মতো নয়, সত্যি কথা বলতে নজরুলের পরই বাঙালি মুসলমান প্রথম বুক ঠুকে সে কথা বলার সাহস অর্জন করে। এর ফলে দেখা যায়, অন্যদের কথা বাদ দিলেও, বিংশ শতাব্দীতে বাঙালি মুসলমান লেখকদের মধ্যে মুক্তবুদ্ধিচর্চার পথিকৃৎ হিসেবে যাঁদের নাম স্মরণ করতে হয় তাঁদের প্রায় সবাই (কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল) তাঁদের আদর্শ বা সাহিত্যসৃষ্টির প্রেরণা হিসেবে ব্যতিক্রমহীনভাবে ও একবাক্যে নজরুলের নামোচ্চারণ করেছেন।
১৯২০ এর দশকের শেষ অবধিও শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে সংগীত চর্চা জায়েজ কি না তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক অব্যাহত ছিল। আকরম খাঁ প্রমুখকে এ সময় পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে সঙ্গীতচর্চা যে ইসলামে হারাম নয় তা প্রমাণের চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু তাতে যে আশু কোনো ফল দর্শেছে তা নয়। এ পর্যায়ে নজরুল এলেন, এবং আসার সঙ্গে সঙ্গে যাকে বলে জয় করলেন। শ্যামা সঙ্গীত ও কীর্তনের পাশাপাশি তিনি ইসলামি পুরাণ-ইতিহাস, মুসলিম উৎসব-পর্ব, ধর্মীয় পুরুষ ও ঐতিহাসিক চরিত্রদের নিয়ে একের পর এক ‘ইসলামি গান’ — হামদ-নাত, গজল ইত্যাদি লিখে চললেন, তারপর কে মল্লিক-আব্বাসউদদীন প্রমুখ এমন কি ছদ্মনামে অনেক হিন্দু শিল্পীকে দিয়েও তা রেকর্ড করালেন। এভাবে বাঙালি মুসলমানের ঘরে ঘরে তিনি সঙ্গীতের প্রবেশাধিকার ঘটিয়ে দিলেন। তাঁর আগে তো নয়ই, পরেও আর এতটা ব্যাপকতায় ও সফলতার সঙ্গে কে এ কাজটি করতে পেরেছেন? শুধু কি তাই? তাঁর ইসলামি গানের জনপ্রিয়তা এমন যে সে গানের কথায় খোদাপ্রেমকে (নিষিদ্ধ পানীয়) শরাবের সঙ্গে তুলনা করেও তিনি ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে তাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারলেন। এ শিল্পের শক্তি বৈ তো নয় ! নজরুলের এ সাফল্যের দিকটি, তাঁর এ ঐতিহাসিক ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করার সামর্থ্য যদি জীবনানন্দ দাশ বা বুদ্ধদেব বসু দেখাতে না পেরে থাকেন তবে তার জন্য তাঁদেরকে আমরা খুব বেশি দোষ দেব না। তবে প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা থেকে শুরু করে তাঁর রচনাবলির বিরাট অংশ জুড়ে যেভাবে ও যতটা দক্ষতার সঙ্গে তিনি হিন্দু ও মুসলমান বাঙলার এ দুটি প্রধান ধর্ম-সম্প্রদায়ের পুরাণ ও ঐতিহ্যকে পাশাপাশি ঠাঁই করে দিয়েছেন, যেভাবে সাংস্কৃতিক সমন্বয় ঘটিয়েছেন, আমরা যদি সত্যিসত্যি হিন্দু-মুসলমান মিলিত অর্থে বাঙালি জাতীয়তা ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হই, তবে নজরুলকে শুধু বাংলাদেশের নয়, বাঙালির জাতীয় কবির সম্মান আমাদের দিতেই হবে।
—
তথ্যসূত্র :
আবদুল মান্নান সৈয়দ (সম্পা.), কাজী নজরুল ইসলাম জন্মশতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ, ঢাকা : ২০০১
ফয়জুল লতিফ চৌধুরী (সম্পা.), জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধ সংগ্রহ, ঢাকা : ১৯৯৫
বুদ্ধদেব বসু, প্রবন্ধ-সংকলন, কলকাতা : ১৯৬৬
(২০১২)
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, ইতিহাসবিদ
করোনাকালের স্থবির দিনগুলো যেন অনেকের জীবন বদলে দিয়েছিল। কেউ হারিয়েছেন চাকরি, কেউ প্রিয়জন, কেউ বা হারিয়েছেন জীবনের গতি। কিন্তু সেই থেমে যাওয়া সময়েই নতুনভাবে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন সুলতানা মুক্তা। দীর্ঘ ১৭ বছরের শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে তিনি তৈরি করেছেন নিজের স্বপ্নের প্ল্যাটফর্ম — ‘ঋক্ষশৈলী’।
রোজকার খবরের বিশেষ প্রতিনিধি ফারজানা জিতুর কাছে সুলতানা মুক্তা তুলে ধরেন তার ‘ঋক্ষশৈলী’র গল্প, সংগ্রাম আর স্বপ্নের কথা। উদ্যোক্তাদের জীবন ও ভাবনা নিয়ে শিল্পপুরাণ ও আরশিনগরের সৌজন্যে রোজকার খবরের নিয়মিত আয়োজনের অংশ হিসেবে আজ প্রকাশিত হল এই বিশেষ প্রতিবেদন।
‘ঋক্ষশৈলী’ মূলত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নিয়ে মেলা আয়োজনের একটি সংগঠন। ছোট ছোট ব্যবসায়ী, ঘরোয়া নারী উদ্যোক্তা, হাতে বানানো পণ্যের কারিগর— সবাইকে এক ছাতার নিচে এনে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর জায়গা তৈরি করেছে মুক্তার এই উদ্যোগ।
‘আমি শিক্ষকতা করতাম অনেক দিন। ২০২০ সালে চাকরি ছেড়ে দিই। মনে হচ্ছিল, জীবনে কিছু একটা নিজের মতো করে করতে চাই,’— বলছিলেন মুক্তা। ‘সেই সময় অনলাইনে Tuna-Tunyy নামে একটি বুটিক পেজ খুলি। উদ্দেশ্য ছিল ব্যস্ত থাকা, কিন্তু ধীরে ধীরে কাজটাই ভালোবাসায় পরিণত হলো।’
ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হওয়া— সেই স্বপ্ন তিনি পূরণও করেছেন। কিন্তু উদ্যোক্তা জীবনের এই অধ্যায় যেন মুক্তার জীবনের দ্বিতীয় প্রেরণা। ‘শিক্ষকতা আমাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে, আর উদ্যোক্তা জীবন দিয়েছে নিজেকে নতুনভাবে গড়ার সুযোগ,’— বললেন তিনি।
শুরুতে পরিবার থেকেই এসেছিল শঙ্কা, সন্দেহ আর কিছু নিরুৎসাহ। “পরিবার বলত— ‘তোমাকে দিয়ে হবে না।’ তখন ভাবতাম, কেন পারব না?”— স্মৃতি হাতড়ে বললেন মুক্তা। ধীরে ধীরে সেই অবিশ্বাসই হয়ে উঠেছে তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি।
তবে মুক্তার গল্প একা লড়াইয়ের নয়— বরং একসঙ্গে এগিয়ে চলার গল্প। ২০২২ সালে অনলাইনে পরিচিত চারজন বন্ধু মিলে প্রথমবারের মতো একটি মেলার আয়োজন করেন তারা। নাম দেন ‘ঋক্ষশৈলী’। প্রথম আয়োজনেই মেলে অভাবনীয় সাড়া। ‘সেই মেলাতেই বুঝলাম— একা নয়, একসঙ্গে কাজ করলেই সফলতা সম্ভব,’ বলেন মুক্তা।
এখন পর্যন্ত ১৭টি মেলা আয়োজন করেছে ঋক্ষশৈলী। প্রতিটি মেলাতেই সুযোগ পেয়েছেন নতুন নতুন উদ্যোক্তারা, যারা হয়তো কখনও দোকানের বাইরে নিজেদের পণ্য দেখানোর সাহস পাননি। মুক্তা বলেন, ‘আমরা এমন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিই, যারা শুরু করছেন একদম নতুন করে। তাদের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের উদ্দেশ্য।’
তবে সহজ ছিল না এই যাত্রা। সংসার, সন্তান, ঘর সামলে উদ্যোক্তা জীবনে সময় দেওয়া— শুরুতে ছিল অসম্ভব কঠিন। মুক্তা বলেন, ‘মেয়েদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ঘর সামলে নিজের জন্য সময় বের করা। ধীরে ধীরে পরিবার বুঝেছে, আমিও ব্যালান্স করতে শিখেছি।’
ব্যর্থতাও এসেছে পথে। মূলধনের অভাব, পণ্য সংগ্রহে সমস্যা, অনলাইন পেজের প্রচার না পাওয়া— সবই পেরিয়ে আজ তিনি আত্মবিশ্বাসী উদ্যোক্তা। তার মতে, ‘সফল হতে গেলে বারবার পড়তে হবে, আবার উঠতেও হবে। জানার শেষ নেই, শেখার শেষ নেই। এই মানসিক প্রস্তুতিটাই বড়।’

পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পেছনে ঘুরতে থাকা তরুণদের তিনি উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘উদ্যোক্তা হলে শুধু নিজের জীবিকার পথ তৈরি হয় না, আরও কয়েকজনের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়। এখন অনেক তরুণ পড়াশোনার পাশাপাশি উদ্যোগ নিচ্ছে— এটা ভালো লক্ষণ।’
নতুনদের জন্য তার পরামর্শ, ‘ধৈর্য ধরতে হবে। কেউ একদিনে সফল হয় না। মানসিকভাবে শক্ত থাকতে হবে। নিজের কাজের বিষয়ে জানতে হবে সব কিছু এবং কখনও হাল ছাড়া যাবে না।’
ঋক্ষশৈলীর সাফল্যের পেছনে মুক্তা ও তার দলের যে নিষ্ঠা, তা এখন অনেক নতুন উদ্যোক্তার অনুপ্রেরণা। মুক্তা বলেন, “আমরা ৬৪ জেলায় কাজ করতে চাই। আমাদের লক্ষ্য, বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সুযোগ তৈরি করা। আর একদিন আমরা যেন দেশের বাইরেও ‘মেড ইন বাংলাদেশ’-্এর গর্ব ছড়িয়ে দিতে পারি।”
সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা নিয়েও তিনি সচেতন। বলেন, ‘আমরা শুধু ব্যবসা নয়, কর্মসংস্থান তৈরি করতে চাই। যেন দেশের তরুণ-তরুণীরা কাজের সুযোগ পায়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।’
শেষে তিনি বললেন একটাই কথা— ‘কোনো কাজেই হাল ছাড়া যাবে না। মনে রাখতে হবে— আমি পারি, আমি পারব, আমাকে পারতেই হবে।’
ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। পরিবারও চেয়েছিল ছেলেটা সরকারি চাকরি করুক, সমাজে প্রতিষ্ঠা পাক। কিন্তু শরিফ আহমেদ পাপ্পু পরে ভাবলেন— চাকরির সামান্য বেতনে হয়তো নিজের সংসার চলবে, কিন্তু সমাজ বদলাবে না। তাই একসময় নিজের ভেতরে প্রশ্ন জাগল, ‘আমি কি আর সবার মতো চাকরির পেছনে ছুটব, নাকি অন্যের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করব?’ সেই প্রশ্নের উত্তরই তাকে বানিয়েছে উদ্যোক্তা।
রোজকার খবরের বিশেষ প্রতিনিধি ফারজানা জিতুর কাছে শরিফ আহমেদ পাপ্পু তুলে ধরেন তার মাস্টার ফ্যাশন প্রতিষ্ঠার গল্প, সংগ্রাম আর স্বপ্নের কথা। উদ্যোক্তাদের জীবন ও ভাবনা নিয়ে শিল্পপুরাণ ও আরশিনগরের সৌজন্যে রোজকার খবরের নিয়মিত আয়োজনের অংশ হিসেবে আজ প্রকাশিত হল এই বিশেষ প্রতিবেদন।
‘আমি দেশের মানুষকে সেবা করার জন্যও, বাংলাদেশের বেকারত্ব দূর করার জন্যও উদ্যোক্তা হয়েছি,’— বলেন উদ্যোক্তা পাপ্পু। তার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিশে আছে তৃপ্তি ও সংগ্রামের গল্প।
শুরুটা ছিল একেবারেই একা। পরিবার তখনও বিশ্বাস করত না, পাপ্পুর পক্ষে কিছু করা সম্ভব। “তারা বলত, ‘তুই পারবি না।’ কিন্তু সেই কথাই আমার চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। আমি প্রমাণ করতে চেয়েছি, পারব, অবশ্যই পারব,” বলেন তিনি।

পাপ্পুর উদ্যোক্তা জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন ‘নিজের বলার মতো গল্প’ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার জাহিদ। সেই ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণেই তিনি শিখেছেন কিভাবে হতাশা জয় করতে হয়, ব্যর্থতা থেকে নতুনভাবে দাঁড়াতে হয়, আর নিজের ব্যবসাকে উন্নতির পথে নিতে হয়।
তবে সাফল্যের আগে ছিল ব্যর্থতার দীর্ঘ অধ্যায়। প্রথম ব্যবসায় ভুল করেছিলেন পণ্য নির্বাচনে। ‘ঢাকার চকবাজার থেকে প্রোডাক্ট কিনে বিক্রির চেষ্টা করি। পরে দেখি, মান ভালো না। তখন নিজেকে প্রশ্ন করলাম— আমি কি টাকা দিয়ে খারাপ পণ্য কিনব? উত্তর ছিল না।’
এরপর আবার নতুন করে শুরু করেন। এবার পণ্যের গুণমান, বাজারের চাহিদা, গ্রাহকের রুচি— সব কিছু নিয়েই গবেষণা শুরু। নিজে থেকেই শিখেছেন মার্কেটিং, সেলস, ও ব্র্যান্ডিং। বলেন, ‘আমি তখন বুঝলাম, আগে শিখতে হবে। না জেনে ঝাঁপ দিলে আবারও হারব।’
‘মাস্টার ফ্যাশন’ এখন তার গর্বের নাম। যদিও এখনও বড় প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেনি, কিন্তু পাপ্পুর চোখে এর ভবিষ্যৎ স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘আমি চাই, আমার প্রতিষ্ঠান একদিন বড় গার্মেন্টস হোক— যেখানে অন্তত ১০ হাজার মানুষ কাজ করবে।’

তবে শুধু ব্যবসা নয়, সমাজকর্মও তার নিয়মিত কাজের অংশ। নিজের এলাকায় তিনি গাছ লাগান, ভাঙা রাস্তা মেরামত করেন, আর তরুণদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ দেন। ‘আমি চাই তরুণেরা চাকরির পিছনে না ঘুরে নিজের কাজ শুরু করুক। উদ্যোক্তা হলে শুধু নিজের রিজিক হয় না, আরও কয়েকটা পরিবারের রিজিকের ব্যবস্থা হয়,’ বলেন পাপ্পু।
নতুনদের জন্য তার পরামর্শ— স্টুডেন্ট লাইফ থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘স্কিল শেখো, কথা বলার অভ্যাস গড়ো, যোগাযোগ বাড়াও, প্রেজেন্টেশন স্কিল উন্নত করো। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটখাটো উদ্যোগ নাও। তখন রিস্কও কম, শেখার সুযোগও বেশি।’

স্বপ্নের পথে এই লড়াই আজও চলছে। নিজের অবস্থান থেকে তিনি বিশ্বাস করেন, উদ্যোক্তারাই বেকারত্ব ঘুচাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছেন। আর এই বিশ্বাসেই এগিয়ে যাচ্ছেন শরিফ আহমেদ পাপ্পু, এক হাতে ব্যবসা, অন্য হাতে সমাজ পরিবর্তনের কাজ নিয়ে।
‘বাংলাদেশকে উন্নত করতে আমি আমার সর্বোচ্চটা দিতে চাই,’— বললেন তিনি, মনে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি নিয়ে।