পদ্মাকে যে দেখেনি বাংলাকে দেখেনি সে; পদ্মাকে যে বোঝেনি বাংলাকে বোঝেনি সে; যা কিছু দেখা জানা বোঝা সমস্ত সংহত এই নদীটির মতো। রাজপুত্রী চিত্রাঙ্গদার মতো শিবের অভিপ্রায় অগ্রাহ্য করে মহানদ জন্মগ্রহণ করলেন মহানদীরূপে। পদ্মা রাজপুত্রী চিত্রাঙ্গদাই বটে। যুগ্মতীরতূণীরা বন্যাবহুল অসংখ্য বন্যযোগ্য সহচরী সহায় স্বেচ্ছাচারিণী শিকারবিনোদে বহির্গমা মহানদী পদ্মা। ভগীরথের সঙ্গ স্বনন অনুসরণ করে ভাগীরথীর সঙ্গে একাকার হয়ে আসছিল, তারপর হঠাৎ করে কী মতি হলো অভীষ্ট পথ অগ্রাহ্য করে, ভাগীরথীর বন্ধন ছিন্ন করে, মহোল্লাসে ঢুকে পড়লো এই পান্ডববর্জিত দেশে। তার পদধ্বনি শুনতে পেয়ে হিমালয়ের ব্রক্ষ্মরন্ধ্র ভেদ করে ছুটে চলে এলো যমুনা নাম ধারণ করা ব্রক্ষ্মপুত্র নদ, ছুটে এলো আসামের দুর্গম অরণ্য লঙ্ঘন করে মেঘনা, তখন তিন জনে তিনে এক একে তিন ভৈরব আবার ধাবিত হলো মহাসমুদ্রের পানে।
গঙ্গা চলেছে দুই কূলের বন্ধন রক্ষা করে, শাস্ত্র এবং আচারের শাসন স্বীকার করে, দেশে দেশে মুক্তি বিতরণ করে, শাপে ভস্মীভূত সগর রাজার দুর্বিনীত সন্তানদের মুক্তিদানের উদ্দেশ্যে। পদ্মা মুক্তিদান করে না, মুক্ত করে। সে শৃঙ্খলকে করে উর্ণতন্তু, পায়ের বেড়িকে করে পায়জোড়, কৃষককে করে কিরিচধারী, করণিককে করে শস্ত্রপাণি, বাদীকে করে বীর, আর মহালগ্ন সমুপস্থিত হলে কারাগারকে দেয় অতলে তলিয়ে, তখন প্রভঞ্জনে বাজে প্রলয়ের শঙ্খ, সেই সামাল সামাল রবের দিনে বীরে আর ভীরুতে, পুরুষে আর নারীতে, শমর্থে ও অশক্তে ভেদ ঘুচে যায়-সকলেই হয়ে ওঠে যোদ্ধা, ঘরে ঘরে বাজে দামামা। তখন সকলে হয় চিত্রাঙ্গদার মৃগয়া সহচর। ভাগীরথী ভারতের বন্দনীয়, আর পদ্মা ভারতের সমস্যারূপিণী। একজনের সকল সমস্যার অন্ত, আর একজন নব নব সমস্যার সৃষ্টি; একজনে জীবনতানের সম, আর একজনে জীবনতানের চিরন্তন ধুয়া, গঙ্গা শান্তি আর পদ্মা অশান্ত।
সেই পদ্মা চলেছে দুই কূল ভেঙে, নভস্পর্শকীর্তিবাসিকে অতলে তলিয়ে দিয়ে, বাগবাগিচা অরণ্য কান্তার পল্লীজনপদ রাজ্য রাজধানী কিছুরই প্রতি তার ভ্রুক্ষেপ নাই। শস্যগৌরবে আজ যে রাজা, গোত্রহীনতায় আজ সে কাঙাল, এক রাতের মধ্যে তাদের ভূমিকা বদলে দেয় খলখলহাসিনী এই খেয়ালিনী। রাজা ও রাখাল, ধনী ও নির্ধন, কৃষক ও ভূস্বামী সকলে তার শাসনে সশঙ্ক। সকলেরই আজ আছে, কাল সম্বন্ধে কেউ নিঃসংশয় নয়। এক পাড়ে ভাঙছে সে ইতিহাস আর এক পাড়ে গড়ছে ভূগোল, এক পাড়ে ভাঙছে কূল, আর এক পাড়ে ফেলছে চর, ভৌগলিক ভেবে পায় না কোথায় তার সীমানা টানবে। ঐতিহাসিকে সম্ভব না হলেও কবিতে আছে সে সম্ভাবনা। সেই আদিমকাল থেকে এই মহানদী অপেক্ষা করে আছে তার যোগ্য মহাকবির জন্য। অবশেষে রবীন্দ্রনাথে পেয়েছে সেই মহাকবিকে।
বাস্তবিক রবীন্দ্রনাথের মতো মহাকবির দৃষ্টিতে পদ্মাকে আর কেউ দেখেনি। বছরের পর বছর ঋতুর পর ঋতু পদ্মাকে নিরীক্ষণ করে তিনি তার বিশ্বরূপ দর্শন করতে সমর্থ হয়েছেন। চর্মচক্ষের দৃষ্টির সঙ্গে ক্রমে যুক্ত হয়েছে কল্পনার দৃষ্টি ও দিব্যদৃষ্টি। এই তিন দৃষ্টির সন্মুখে পদ্মা উদঘাটিত করে দিয়েছে তার অপার রহস্য, কিছুই গোপন রাখেনি। কেনইবা রাখবে? সেতো অনাদিকাল থেকে অপেক্ষা করে ছিল এমন একজন মহাকবির জন্যে। কবির চোখে, ভাবুকের চোখে যে তাকে দেখতে চাইবে। তার আশা এতোদিনে সফল হয়েছে। কবি দেখেছেন ঋতুভেদে তার বেশ ও বসন পরিবর্তন। নববর্ষায় নীল, ভরা বর্ষায় গৈরিক, শরতে আসমানি, শীতে সবুজঘেঁসা, শীতান্তে স্বচ্ছ ডুরে আর বসন্তে বালুচরী। বসনের কত রঙ, কত রঙের বসন। সে সব বসনে রাতের বেলায় তারার ফুলকাটা, দিনের বেলায় নানা রঙের মেঘের ছোপ, আর রোদ্রের আভায় প্রত্যেক তরঙ্গশীর্ষে মনিমুক্তা হিরকের কাজ। আর রূপেরই কী অন্ত আছে? কখনো তরঙ্গভীষণ, কখনো প্রভঞ্জনে উন্মাদ, কখনো বিলাসান্তে শ্রান্তক্লান্ত শয্যাশায়িতা, কখনোবা অসংখ্য তরণীর সাদা পালের চন্দনের পত্রলেখায় অপরূপা, আর শীতান্তে ডুরে শাড়িখানা গায়ে জড়িয়ে তন্বী কিশোরীর মতো চঞ্চল চরণে গৃহকার্যনিরতা বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড় ভালোবাসি।
রবীন্দ্রচিত্তের গতিমন্ত্রের দীক্ষাদাত্রী তখন পদ্মানদী। বহুকাল পরে এলাহাবাদের গঙ্গার চির চলমান রূপ দর্শনে গতিময় বিশ্বের যে কল্পনা কবির মনে জেগেছিল সেই গঙ্গার মধ্যেই এই পদ্মার প্রতিফলন। পদ্মা, গঙ্গা, আকাশগঙ্গা তিনটি ক্রমপ্রাগ্রসর পদক্ষেপ। বলাকায় বিবৃত গতিতত্ত্বের মূলানুসন্ধানের জন্য কোন বিদেশি দার্শনিকের বা ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের শরনাপন্ন হওয়া আবশ্যক। এ ভাবটি ধীরে ধীরে কবির মনের বীজ থেকে পল্লবিত হয়ে উঠেছিল। ছিন্নপত্রাবলীতে তার বিবরণ এবং পদ্মায় তার মূল নিহিত। কবিত্বের বিকাশ তত্ত্ব থেকে নয়, স্বোপার্জিত অনুভূতি থেকে। সেই অনুভূতির প্রথম আভাস কবিচিত্তে দিয়েছে পদ্মানদী। চর্মচক্ষের দর্শন কল্পনানেত্র হয়ে দিব্যদৃষ্টিতে পৌঁছেছে। পদ্মার এই ভাঙন প্রবনতার জন্যই বুঝিবা হাডিঞ্জ ব্রিজের মতো একটা বড় সেতু নির্মাণের চেয়ে এর নদীশাসনের বিষয়টিকে প্রকৌশলীদের বেশি মনোযোগ দিতে হয়েছিল।
(লেখাটি ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ইতিহাস’ গবেষণা গ্রন্থ থেকে গৃহীত)
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক, কবি, কথাসাহিত্যিক।
প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ আর নেই। শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া জানান, শুক্রবার শাহবাগের সুপার হোম হোস্টেল থেকে তাকে অজ্ঞান অবস্থান উদ্ধার করে পিজি হাসপাতালে (বিএসএমএমইইউ) নেয়া হলে সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
কবির ভাতিজি রিনি বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে পিজি হাসপাতাল থেকে কবি হেলাল হাফিজের মরদেহ গোসলের জন্য মোহাম্মদপুর তাকওয়া মসজিদে নেওয়া হয়েছে। পরে সেখান থেকে পুনরায় তার মরদেহ পিজি হাসপাতালে রাখা হয়েছে।
কবি হেলাল হাফিজের বড় ভাই দুলাল হাফিজ জানান, কবির প্রথম জানাজা শনিবার সকাল ১১টায় বাংলা একাডেমিতে এবং বাদ যোহর জাতীয় প্রেসক্লাবে দ্বিতীয় জানাজা শেষে নেত্রকোনায় নিয়ে যাওয়া হবে। পরে তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে।
হেলাল হাফিজকে কোথায় সমাহিত করা হবে এ বিষয়ে মৃত্যুর আগে কবি কিছু বলে গেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, মৃত্যুর পর কোথায় রাখা হবে তা কখনো তিনি বলতেন না। তার আসলে আর কখনো ঘরে ফেরাই হলো না।
সুপার হোম হোস্টেলের ম্যানেজার জায়েদ আল সাবিত বলেন, আমার সঙ্গে আজ সর্বশেষ দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে কথা হয়। বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। রক্তাক্ত অবস্থায় আনুমানিক ২টা ১০মিনিটের দিকে বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে তাকে পিজি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে পৌঁছানোর পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্ম গ্রহণ করেন বরেণ্য কবি হেলাল হাফিজ।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ দিয়েই মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন হেলাল হাফিজ। এ কাব্যগ্রন্থভুক্ত প্রতিটি কবিতার শেষে উল্লিখিত তারিখ থেকে জানা যায়, কবিতাগুলো লেখা হয়েছে ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে।
প্রথম কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে হেলাল হাফিজ পাঠক মনে যে নাড়া দিয়েছেন, তা এখনও ইতিহাস হয়ে আছে। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থটির এখন পর্যন্ত ৩৩ বা তারচেয়ে বেশি সংস্করণ হয়েছে। যা এর আগে বাংলাদেশের কোনো কবিতার বইয়ের বেলায় ঘটেনি। এই কবিতার বইয়ের পাঠকের সংখ্যা যে অগণিত, তা বলাই বাহুল্য।
‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থই হেলাল হাফিজকে দিয়েছে অসামান্য খ্যাতি। এরপর দীর্ঘদিন আর কোনো বই বের করেননি তিনি। ২০১২ সালে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার সঙ্গে কিছু কবিতা যুক্ত করে প্রকাশ করা হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় তৃতীয় কবিতার বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’।
কবিতার জন্য ২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান।
এত কম কবিতা লিখে এত খ্যাতি পাওয়ার নজির বাংলাদেশের সাহিত্যে নেই।
১৯৬৫ সালে হেলাল হাফিজ নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ওই বছরই কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক ‘পূর্বদেশে’ সাংবাদিকতা শুরু করেন।
১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সাহিত্য-সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক ‘দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য-সম্পাদক পদে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।
কবিতায় অসামান্য অবদানের স্মারক হিসেবে হেলাল হাফিজকে ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। এ ছাড়াও তিনি পেয়েছেন- যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেকদাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা।
কবি হেলাল হাফিজের লেখালেখির সূচনা ঘটে ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি তাকে কবিখ্যাতি এনে দেয়। সাংবাদিকতা করার দরুণ কবি ওই সময়ের উত্তাল পরিবেশের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পেরেছিলেন।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কবি হাসান হাফিজ ও সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া এক শোক বার্তায় সাংবাদিক ও কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ শোক বার্তায় মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রাত গভীর সমবেদনা জানান।
সাংবাদিক ও কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছে।
২.
মাজহারুল হক মন্টু। যশোরের ছাত্র রাজনীতির অঙ্গনে একটা পরিচিত নাম। স্নাতক শেষবর্ষের ছাত্র। স্কুলজীবন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ১৯৬৯ সালের স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে তার রয়েছে অনন্য সাধারণ ভূমিকা। তাছাড়াও ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে সক্রিয় প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে দলের ভেতরে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে তুলেছেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের পর ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আওয়ামী লীগের নানা টানাপোড়েন শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পূর্বে আহুত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর সারা বাংলাদেশের মতো যশোর শহরেও প্রবল গণআন্দোলন শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় যশোর শহরের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে এসে আন্দোলন শুরু করে। ৩ মার্চ ছাত্র-জনতার একটা মিছিল যশোর কালেক্টর ভবনে উড্ডীন পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা নামিয়ে একটা কালো পতাকা উত্তোলন করে যখন ফিরে আসছিল, তখন টিএন্ডটি ভবন থেকে পাকিস্তানি সেনারা গুলি বর্ষণ করলে চারুবালা নামে একজন গৃহবধূ নিহত হন। যার ফলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে থেকে বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে সারা বাংলাদেশের মতো যশোরেও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। তখন প্রতিদিনই শহরে চলতে থাকে প্রতিবাদ মিছিল, মিটিং।
২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে ছাত্রনেতা খান টিপু সুলতানের নেতৃত্বে যশোর শহরের নিয়াজ পার্কে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৫ মার্চের রাতের আঁধারে হানাদার খান সেনারা যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরে প্রবেশ করে রাস্তায় অবস্থানরত জনতার উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে অনেক সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। অন্যদিকে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই সারাদেশে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মাযহারুল হক মন্টু একজন ছাত্রনেতা হিসাবে যশোর শহরের আন্দোলনের প্রতিটা স্তরে যথাযথ ভূমিকা রাখার পাশাপশি শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু সাধারণ ৩০৩ রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করে আধৃুুনিক অস্ত্র সজ্জিত শত্রুসেনাদের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত হয়ে তার নেতৃত্বে একটা গেরিলা দল নিয়ে গত ৭ দিন আগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যশোর সদর থানার প্রত্যন্ত এলাকা কাশিমপুর গ্রামে সেল্টার গ্রহণ করেন। তিনি কলেজ পড়ুয়া একজন যুবক হলেও তাকে দেখে মনে হয় যেন একজন আর্মি অফিসার। কথাবার্তায় চালচলনে যেন আভিজাত্য ঝরে পড়ে। সামরিক বাহিনীতে সৈনিকদের যেমন কড়া আইন কানুনের মধ্যে থাকতে হয়, তেমনি তার অধীনের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের থাকতে হয় কঠোর আইন কানুনের মধ্যে। পান থেকে চুন খসলেই কারো রেহাই নেই। সেন্টি ডিউটি বা রেকি করা কোন কাজেই সামান্যতম অবহেলাও তার সহ্য হয় না।
সেই কড়া স্বভাবের মাজহারুল হক মন্টুকে আজ কিন্তু খুব প্রাণখোলা এবং খোশমেজাজে দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে অবশ্য একটা বড় কারণ আছে । তাহলো তার নেতৃত্বে আরও কয়েকটি গেরিলা দল মিলে আজ ভোর রাতে যশোর শহরের পূর্বের খাজুরা হাই স্কুল রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে বেশ কিছু রাজাকারকে হত্যা করে সফলতা দেখিয়েছে। অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের এই সফলতার পেছনে মোঃ ইসহাক নামের একজন সামরিক প্রশিক্ষপ্রাপ্ত মুজাহিদ সদস্যের অবদান সবচেয়ে বেশি। মুক্তিযোদ্ধা দলের সদস্য না হয়েও সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং খাজুরা রাজাকার ক্যাম্পের পাশের লেবুতলার গ্রামে বাড়ি হওয়ায় ক্যাম্পটির সেন্টি পোস্ট ও অন্যান্য অবস্থান সম্বন্ধে তার স্পষ্ট ধারণা ছিল। সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হওয়ায় যশোর অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে ইসহাক ইপিআর বাহিনীর সাথে প্রথম পর্যায়ের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সেই যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর প্রতিরোধ যোদ্ধারা ভারতে চলে গেলেও নতুন বিবাহিত স্ত্রী এবং পরিবারের অসুবিধার কথা ভেবে সে ভারতে যাওয়া থেকে বিরত ছিল। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করার পর সে আর ঘরে বসে থাকতে পারেনি। মাজহারুল হক মন্টুর গেরিলা দলটি কাশিমপুর গ্রামে সেল্টার গ্রহণ করার পর থেকেই সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে মন্টু সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে। তারর যোগ্যতা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার প্রচণ্ড আগ্রহ দেখে মন্টু সাহেব তাকে নিজ দলে অন্তভূক্ত করে নেন।
কাশিমপুর গ্রামে সেল্টার গ্রহণ করার পর থেকেই খাজুরা হাই স্কুল রাজাকার ক্যাম্পের নানা অপকর্মের কথা মন্টু সাহেবের কানে আসছিল। মাত্র ১০/১২ দিনের মধ্যে ২টি বাড়ি লুট এবং বেশ কয়েকজন নারীর সম্ভ্রমহানীর সাথে তাদের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় অন্যান্য গেরিলা কমান্ডারের সাথে আলোচনা করে মন্টু সাহেব খাজুরা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর একই এলাকায় বাড়ি, অবাধ যাতায়াতের সুযোগ এবং সামরিক বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হওয়ায় ক্যাম্পটি সরেজমিনে রেকি করে একটা খসড়া আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়ণের জন্য তিনি ইসহাককে দায়িত্ব প্রদান করেন। সেও সুযোগটি মনেপ্রাণে গ্রহণ করে। তারপর অবাধ যাতায়াতের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটা নিখুঁত আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সে তা মন্টু সাহেবের নিকট জমা দেয়। সেই আক্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে ৫ জন গেরিলা কমান্ডার আলোচনা করে সামান্য কিছু কাটছাট করে চুড়ান্ত করা হয়। তারপর মাযহারুল হক মন্টুর নেত্বত্বে ৫টা গেরিলা দলের ৫৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আজ ভোর তারা রাতে খাজুরা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে শতভাগ সফলতা লাভ করে। শুধু যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়নে সহযোগিতা নয়, ইসহাক অস্ত্র হাতে সরাসরি গুলিতে শত্রুর ২ জন সেন্টিকে হত্যা করে যুদ্ধ জয়ে অনেক ভূমিকা রেখেছে। তাইতো আজ সারাদিন ক্যাম্পে একটা আনন্দের আমেজ লেগে আছে। সাথে সাথে চলছে ইসহাক বন্দনা।
চলবে…