দেশ, নির্বাচিত

দেশ, নির্বাচিত

আদি বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষায় নোঙরের নৌকা র‌্যালি ও ৯ দফা দাবি

নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় ৯ দফা দাবিসহ ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বুড়িগঙ্গা নদী ও তার ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও নৌকা র‌্যালি করলো নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি নিরাপত্তার সামাজিক সংগঠন নোঙর ট্রাস্ট।

শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) দিনব্যাপী বুড়িগঙ্গা এবং আদি বুড়িগঙ্গা নদীতে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়।

এই দিন দুপুরে আদি বুড়ীগঙ্গা নদী থেকে খোলামোড়া পর্যন্ত দেশের নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় ৯ দফা দাবিতে নৌকা র‌্যালি করে  নোঙর ট্রাস্ট।

বুড়িগঙ্গার নদীর একশত জন নৌকার মাঝিদের কম্বল বিতরণ করার মাধ্যমে নৌ-র‌্যালি উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট মোঃ কামরুল ইসলাম।

নোঙর ট্রাস্ট চেয়ারম্যান সুমন শামস-এর সভাপতিত্বে ও ৫৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইদুল ইসলাম মাদবরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠানে সহযোগী হিসেবে ছিল সামাজিক সংগঠন রিভার জাস্টিস ও সচেতন নগরবাসী।

অনুষ্ঠানের সভাপতি নোঙর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান সুমন শামস বলেন, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে কামরাঙ্গীরচরের কোল ঘেঁষে বয়ে চলতো আদি বুড়িগঙ্গা। সে নদীতে এখানে জলের প্রবাহ দেখা যায় না। যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু ময়লা আর অবর্জনা। প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার নদীর জায়গায় জায়গায় দখল, গজিয়ে উঠেছে কাঁচাপাকা অবৈধ স্থাপনা। এ দৃশ্য এখন রাজধানীর চারদিকের প্রত্যকেটি নদীর। এই মরণদশা থেকে রাজধানী ঢাকা শহরকে বাঁচাতে হলে আদি বুড়ীগঙ্গা নদী, বুড়ীগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা নদী, বালু নদী, তুরাগ নদীসহ ঢাকা শহরের হারিয়ে যাওয়া ৪৭টি খাল বাঁচাতে হবে। তা না হলে এই শহর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।

বেড়িবাঁধ আর চরের মধ্যবর্তী জায়গায় বুড়িগঙ্গার একটি চ্যানেল ছিল আদি বুড়িগঙ্গা নামে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আদি বুড়িগঙ্গা আধমরা বুড়িগঙ্গায় রূপ নিয়েছে। স্থানীয়দের দখল আর দূষণে পানির প্রবাহ খুঁজে পাওয়া দায়। বেড়িবাঁধ সিকসনের বিপরীতে কামরাঙ্গীরচরের রনি মার্কেট গড়ে উঠেছে নদীর জায়গা দখল করে। বেড়িবাঁধ থেকে চরে ঢুকতে হয় ছোট একটি সেতু পার হয়ে। প্রাায় ৫০ ফুট দীর্ঘ সেতুর নিচে তাকালে এখন আর পানির প্রবাহ দেখা যায় না। এমনকি সেতু থেকে দুই পাশে তাকালে কোথাও পানির প্রবাহ চোখে পড়ে না। বরং পানি প্রবাহের বদলে সেখানে জমে আছে ময়লার বিশাল স্তূপ। কামরাঙ্গীরচরের মুসলিমবাগ থেকে রায়েরবাজার পর্যন্ত আদি বুড়িগঙ্গার প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ এই চ্যানেলের দুই পাশে এখনো রয়েছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর হস্তক্ষেপ না থাকায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা গত ৫০ বছর সময় ধরে আদি বুড়িগঙ্গার ওপর গড়ে তুলেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বহুতল ভবন।

তিনি আরো বলেন, ইসলামবাগ থেকে কালুনগর পর্যন্ত বেড়িবাঁধের পাড় ঘেঁষে দেখা গেছে বিপুল অবৈধ স্থাপনা। এর মধ্যে রয়েছে পাকা, আধাপাকা ও টিনের ঘর, রিকশার গ্যারেজ, ট্রাকস্ট্যান্ড, ট্রেম্পুস্ট্যান্ড, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কারখানা। রয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও। বেড়িবাঁধের সড়ক ও কামরাঙ্গীরচরের দুই পাশ থেকে ময়লা ফেলে আদি বুড়িগঙ্গা ভরাট করা হয়। ময়লা ফেলে ভরাটের পর সে অংশে গড়ে তোলা হয় রিকশার গ্যারেজ বা কাঁচা স্থাপনা। রনি মার্কেট অংশে খালের ওপর গড়ে উঠেছে মার্কেটের বর্ধিতাংশ, পাকা স্থাপনা। দিনের পর দিন ময়লা ফেলে বেড়িবাঁধ অংশের সঙ্গে গড়ে তোলা হয়েছে বিশালাকার টেম্পুস্ট্যান্ড, ট্রাকস্ট্যান্ড, দোকান ও বসতবাড়ি। কোম্পানিঘাট এলাকায় খালের ওপর কায়দা করে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছে মেটাডোর কোম্পানি। মসজিদ বরাবর আদি বুড়িগঙ্গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে কোম্পানিটির কারখানা। মেটাডোরের পাশে থাকা পান্না ব্যাটারিও দখল করে আছে আদি বুড়িগঙ্গা। কোম্পানি দুটির বিপরীত পাশে রয়েছে স্থানীয়দের আরও অনেক অবৈধ স্থাপনা।

কামরাঙ্গীর চরের পরে হাজারীবাগ, ঝাউচর, বউবাজার ও রায়েরবাজার অংশে আদি বুড়িগঙ্গার দেখা মেলে নামমাত্র। দুই পাড়ের বসতবাড়ি, বাজার ও কারখানা থেকে সব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পানিতে। ফলে পানির প্রবাহের জায়গা ময়লার বিশাল স্তূপ গড়ে উঠেছে। ভাসমান এ ময়লার স্তূপ এতটাই পুরু হয়েছে যে, এর ওপর দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারে। নিচে পানির প্রবাহ রয়েছে তা নিশ্চিত হতে অন্তত এক ফুট পরিমাণ ময়লা সরাতে হয়।

বুড়িগঙ্গা নদীসহ রাজধানীর চারপাশের নদী দখল-দূষণ এবং নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গণসচেতনতামূলক কর্মসূচিতে দেশের সকল শ্রেণির নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে দেশের নদী ও প্রাণ প্রকৃতি সংরক্ষণে নোঙর বাংলাদেশের এ আন্দোলন ধারাবাহিক ভাবে চলমান থাকবে।

নদী রক্ষার ৯ দফা দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী মোঃ আবুল হোসেন সরকার, কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মোঃ সোলায়মান মাদবর, বুড়ীগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক জনাব মিহির বিস্বাস, সচেতন নাগরিক সমাজের আহবায়ক জনাব রুস্তম খান, পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি জনাব আমির হোসেন মাসুদ, রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও নদী গবেষক আইরিন সুলতানা, স্বপ্নের সিঁড়ি এর নির্বাহী পরিচালক উম্মে সালমা, নদী ও পরিবেশ কর্মী জনাব মোম্মদ সেলিম।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন নোঙর বাংলাদেশ পরিবারের সম্মানিত সদস্য এফ এইচ সবুজ, ফজলে সানি, আবির বাঙালী, মোহাম্মদ আবদুর রহিম, আমিনুল হক চৌধুরী, বাহারুল ইসলাম, মিজানুর রহমান, শরফরাজ শাওন, সৈয়দা কবিতা রিমি, মীর মোকাদ্দেস আলী, মোহাম্মদ শাজাহান, মোহাম্মদ জালাল হোসেন জুয়েল, মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির, কাজী নূরউদ্দীন রানা, মাহাতাব, মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনসহ আরো অনেকে।

নোঙর ট্রাস্টের ৯ দফা দাবি :
১) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকল রাজনৈতিক দলের ইস্তেহারে দেশের সকল নদী, খাল, বিল, বিল, হাওরবাওর, পুকুর, জলাশয়, প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সকল সাংসদের শপথ গ্রহণ করতে হবে।

২) আদালতের নির্দেশ মেনে ১৯৪০ সালের সিএস নকশাসহ আরএস, বিএস, এসএ, ড্যাপ এবং জলাধার আইন অনুযায়ী সকল জেলার নদী-শাখা নদী ও খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে এবং সীমানা পিলার স্থাপন করে পুণরায় প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।

৩) রাজধানীর হারিয়ে যাওয়া ৪৭টি খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে বৃত্তাকার নৌপরিবহণ চালু করতে হবে।

৪) নদীর সকল বাঁধ, স্বল্প উচ্চতার সতেু-কালর্ভাট অপসারণ করে নৌ পরিবহন যোগ্য নৌপথ তৈরি করতে হবে।

৫) নদী দখল-দূষণকারী, বালু খেকো, ভূমি দস্যুদেও সকল ধরণের নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে।

৬) সমুদ্র-পাহাড়, বনভূমি, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে।

৭) দেশের স্বার্থে ‘জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭’ অনুস্বাক্ষর করার মাধ্যমে সকল অভিন্ন নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের বাধা অপসারণ করতে হবে।

৮) ফারাক্কা-তিস্তাসহ ৫৪টি আর্ন্তজাতিক নদীর পানি ন্যায্যতার সঙ্গে ব্যবহারের চুক্তি স্বাক্ষর করা এবং ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্প বাতিলের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

৯) আগামী দিনে নৌ-নিরাপত্তা নিশ্চত করতে দেশের নৌপথে নিহত সকল শহীদের স্মরণে ‘২৩ মে জাতীয় নদী দিবস’ ঘোষণা করে সরকারিভাবে গেজেটভূক্ত করতে হবে।

বিষয়:
পরবর্তী খবর

বসুন্ধরা পারলে কেন সিটি করপোরেশন পারবে না

ভোররাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল। সারা রাত আকাশে মেঘ ছিল। আষাঢ় শেষ হয়ে আসছে। বর্ষাকাল। এখন এরকমই হওয়ার কথা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হবে হঠাৎ করেই। ঝুপ ঝুপ করে নামবে বৃষ্টি। কখনও থেকে থেকে, কখনও অবিরাম। এ বছরের বর্ষায় প্রবল বৃষ্টি হতে পারে, আবহাওয়াবিদরা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তন এখন পৃথিবীর সবচাইতে বড় সমস্যা। যেদিন আমরা পিছনে ফেলে এসেছি, যে আবহাওয়ায় বড় হয়েছি, সেই আবহাওয়া এখন আর নেই। শীতের দেশগুলোতে তীব্র গরম পড়ছে। শীতকালে শীত পড়ছে আগের তুলনায় বেশি। বরফের পাহাড় গলে যাচ্ছে আন্টার্টিকায়। দাবানলে পুড়ছে আমেরিকার বনভূমি। প্রকৃতি উল্টো-পাল্টা হয়ে গেছে। বদলে গেছে বহু কিছু।

এ বছরের গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। জীবজগৎ বিপর্যস্ত। আবহাওয়াবিদরা বলেছিলেন, বর্ষায় প্রবল বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। ক’দিন আগে তাই হলো। ভোররাত থেকে বৃষ্টি। সকাল দশটা এগারোটা পর্যস্ত থামার নাম নেই। আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ছায়াময় পরিবেশ। আমি একটু বেলা করে উঠেছি। মধ্যমাত্রার বৃষ্টি তখনও ঝরছে। দুপুর নাগাদ টেলিভিশন আর অনলাইনগুলো দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ঢাকা শহরের বহু এলাকা বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে। রিকশার পাদানিতে উঠে গেছে পানি। বাসের চাকা ডুবে গেছে। প্রাইভেটকার ডুবে গেছে, জেগে আছে শুধু গাড়ির ছাদটুকু। নিউমার্কেট আর কাঁটাবন এলাকার দোকানপাটের ভিতর কোমর পানি। ছোট আর মাঝারি ব্যবসায়ীরা পড়ে গেছেন ব্যাপক সংকটে। দোকানের মালামাল রক্ষা করতে পারেননি। সব ভেসে গেছে বৃষ্টিতে। শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে।

অন্যদিকে মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। কর্মস্থলে যাওয়া মানুষ, বাড়ি ফেরার মানুষ, ছাত্র-ছাত্রী প্রত্যেকেই পড়েছে চরম দুর্ভোগে। গাড়ি চলছে না। হেঁটে বাড়ি ফিরছে মানুষ। তাদের কোমরের ওপর পর্যন্ত পানি। পুরান ঢাকার অলিগলি রাজপথ ডুবে গেছে। ঘরে ঢুকে গেছে পানি। মানুষ দিশেহারা। এ অবস্থা কেমন করে সামাল দেবে? এক বেলার বৃষ্টিতে জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত। অথচ কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশনের জন্য। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বৃষ্টি হলেই ডুবছে রাস্তাঘাট। বিপাকে পড়ছে মানুষ। আবহাওয়াবিদদের সাবধানতা বা ভবিষ্যদ্বাণী সিটি করপোরেশন দুটো সেভাবে মনে রাখেনি। মনে রেখে আগাম ব্যবস্থা নিলে শহরবাসী এরকম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ত না। এই বিষয়ে দুই মেয়রের তীক্ষ্ণ নজর থাকা জরুরি ছিল। ঢাকার খালগুলো প্রায় সবই বুজে গেছে। দখল হয়ে গেছে। সবই আছে খালগুলোতে, শুধু পানিটাই নেই। পানির প্রবাহ বলতে কিছু নেই। ময়লা আবর্জনার ভাগাড় হয়ে গেছে একেকটা খাল। মেয়র মহোদয়দের দেখি, প্রায়ই খাল উদ্ধারের অভিযান করছেন। দু-একটা খাল দখল মুক্তও করছেন। তারপর আর খবর নেই। আগের মতো দখল হয়ে যাচ্ছে। আরেক মহাশত্রু হয়েছে পলিথিন। এই জিনিসের কোনও বিনাশ নেই। শুধুমাত্র পলিথিনই ডুবিয়ে দিচ্ছে অনেক অর্জন। এই বিষয়টি নিয়ে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সচেতন হওয়া জরুরি। পলিথিনের হাত থেকে বাঁচাতে হবে দেশ। পলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থা কাজে লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও মিডিয়া মিলে জনসচেতনা গড়ে তোলা জরুরি। মানুষ সচেতন হলে সমাজ পরিশিলিত হয়। গত তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা। এখন বসুন্ধরা ঢাকার সবচাইতে অভিজাত এলাকা। সবচাইতে আকর্ষণীয় এলাকা। বসুন্ধরায় কারও একটি ফ্ল্যাট বা কারও এক টুকরো জমি থাকলে তিনি খুব গৌরববোধ করেন। বসুন্ধরার মতো সুবিন্যস্ত আবাসিক এলাকা ঢাকায় আর নেই। এলাকাটির পরিকল্পনা করা হয়েছে সম্পূর্ণতই ইউরোপ-আমেরিকার ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর লাগোয়া অতি আধুনিক আবাসিক শহরগুলোর মতো করে। সুপরিকল্পিত ও সুব্যবস্থাপূর্ণ। বড় বড় রাস্তা। রাস্তার ধার আর আইল্যান্ডগুলো সবুজ গাছপালায় ভর্তি। রাজউকের বিল্ডিংকোড মেনে নির্মিত প্রতিটি বাড়ি। সঙ্গে আছে বসুন্ধরার নিজস্ব কঠোর তদারকি। নিয়মের বাইরে একটি ইটও বসানো যাবে না। একটি গাছের পাতাও ছেঁড়া যাবে না। অন্যদিকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুরুষমানুষরা তো বটেই, নারী ও শিশুরা চাইলেও রাত দুপুরে বাড়ির বাইরে বেড়াতে বেরোতে পারে। ডিস্টার্ব করা তো দূরের কথা, চোখ তুলেও তাকাবার সাহস পাবে না কেউ। নিরাপত্তায় নিয়োজিত গাড়িভর্তি কর্মী চব্বিশঘণ্টা টহল দিচ্ছে। ঢাকার ভিতরেই বসুন্ধরা সম্পূর্ণ এক আলাদা জগৎ। স্বপ্নের বাসভূমি। এটা সম্ভব হয়েছে সুপরিকল্পনা ও তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন আর প্রয়োগের ফলে। গত কয়েক বছর আগে বর্ষার বৃষ্টিতে বসুন্ধরার কোথাও কোথাও পানি জমে যেত। এই নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন কর্তৃপক্ষ। সুদূর প্রসারী আধুনিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে রাতারাতি সামাল দিলেন সেই সমস্যা। গড়ে তুললেন অত্যাধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা। যত বৃষ্টিই হোক, বসুন্ধরায় এখন আর পানি জমে না। জোরালো ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে বৃষ্টির পানি এক মিনিটও দাঁড়াতে পারে না। সঙ্গে আছে এলাকার ড্রেনগুলোর সঠিক তদারকি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বহুকর্মী নিয়োজিত এই কাজে। কী নেই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়? হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, খেলার মাঠ, শপিং মল, সুন্দর সুন্দর মসজিদ, গোরস্থান, অতি আধুনিক সব রেস্টুরেন্ট। এক কথায় সব মিলিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা বর্তমান বিশ্বের অতি আধুনিক এক মনোরম শহর। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা নিয়ে কথাগুলো বলার কারণ, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র মহোদয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বসুন্ধরায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার অনুকরণ করে তাঁরা খুব সহজেই হঠাৎ বৃষ্টিতে জলাবদ্ধ হয়ে যাওয়া ঢাকা শহরকে অনেকখানি মুক্তি দিতে পারেন। মানুষকে দুর্ভোগ মুক্ত করতে পারেন, ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে পারেন ক্ষতির হাত থেকে। ছাত্র-ছাত্রী আর পথচলা মানুষদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে পারেন। বৃষ্টির তোড়ে হঠাৎ অসহায় হয়ে পড়া গৃহবাসীদের সুরক্ষা দিতে পারেন। এই শহরের মানুষকে স্বস্তিতে বসবাস করার সুযোগ করে দিতে পারেন। এসব তাঁদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয় তাঁরা ভাববেন। তাঁদের চোখের সামনেই তো উদাহরণ হিসেবে আছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা।

পরবর্তী খবর

মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস

রক্তের মূল্যে স্বাধীনতা

১৯৭১ সালের জুন মাসের শেষ দিক। বাংলাদেশে তখন চলছে পাকিস্তানি কসাই সেনাদের রক্তের হলিখেলা। ২৫শে মার্চের কাল রাত থেকে তারা সারা বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের উপর আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যার পাশাপাশি গ্রামের পর গ্রামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী ধর্ষণসহ নানা পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে মেতে উঠেছে। অন্য দিকে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা– ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ দেওয়ার পর থেকেই দেশে শুরু হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই সারা বাংলাদেশে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ যুদ্ধ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ই এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ এবং তার অল্প কিছু দিনের মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যগাথা শুনে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ যেমন উৎফুল্ল হয়ে উঠতো, তেমনি বাঙালি যুবকেরা মুুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে অনুপ্রেরণা খুঁজে পেত। যার ফলে দেশের ভেতর থেকে যুবক ছেলেরা দলে দলে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে শুরু করে।

দিনে দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে পাকি সেনারাও নতুন ফন্দি আঁটে। নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য স্বাধীনতাবিরোধী জামাতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামসহ অন্যান্য স্বাধীনতা বিরোধী দলের সহযোগিতায় তারা রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী গঠন-কাজে হাত দেয়। জুন মাসের প্রথম দিকে তাদের এই বাহিনী গঠন-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এই মাসের মাঝের দিকে জামাত নেতা লেবুতলা গ্রামের ইব্রাহিম ডাক্তারের নেতৃত্বে (হাতুরে ডাক্তার) যশোর শহর থেকে ২০ মাইল পূর্বে খাজুরা উচ্চ বিদ্যালয়ে একটা রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করার পর থেকেই তারা গ্রামের সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার, নির্যাতন, বাড়িঘর লুটপাট এবং নারী ধর্ষণের মতো গর্হিত কাজ শুরু করে দেয়। শুধু তাই না মাত্র ১০/১২ দিনের মধ্যেই লেবুতলা গ্রামের নিমাই কাপালি, গৌর মাষ্টারের বাড়িতে লুটপাট ও খাজুরার আলিয়র রহমানের স্ত্রী ও ২ বোনকে ধরে নিয়ে গিয়ে সম্ভ্রমহানী করার পর তারা এলাকায় মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়ে গেছে। এখন গাঁয়ের মানুষদের জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘের মতো অবস্থা। প্রতি রাতেই যেমন পাকিস্তানি কসাই সেনারা বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ চালাচ্ছে, তেমনি দিনের বেলায় রাজাকার ও আল বদরেরা গ্রামে গ্রামে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও নানা অসামাজিক কাজে মেতে উঠছে। শত্রুদের এই দ্বিমুখী আক্রমণে আজ বাংলাদেশের প্রতিটা এলাকায় নরকের যন্ত্রণা নেমে এসেছে। তাদের জীবন ও জীবিকা এলোমেলো হয়ে গেছে।

খান সেনাদের আক্রমণের আগাম খবর জানার জন্য এখন মানুষ তাদের রাতের ঘুমকে হারাম করে গাঁয়ে গাঁয়ে সারা রাত পাহারা বসিয়েছে। নির্ঘুম রাত কাটানোর পর দিনের বেলায় যে একটু শান্তিতে ঘুমাবে তারও কোন উপায় নেই। কারণ কখন যে রাজাকার আল বদরেরা হামলা করে বাড়ি ঘরে লুটপাট কিংবা যুবতি নারীদের অপহরণ করে নিয়ে যায় সেই চিন্তায় তাদের উৎকন্ঠিত থাকতে হয়। দিনের আলোয় তবুও মনে একটু বল পাওয়া যায়। কিন্তু রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে মানুষের জীবনও যেন ঘোর অন্ধকারে ছেয়ে যায়। তখন তাদের মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক খায়– পরিবারের সবার জীবন রক্ষা করতে পারবো তো? বাড়ির যুবতি মা, বোন, কন্যার সম্ভ্রম রক্ষা করা যাবে তো? রাত যত গভীর হতে থাকে মানুষের মনের আতঙ্কও ততো বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরই মধ্যে এলাকায় জোর গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতরে প্রবেশ করেছে। কেউ তাদের চোখে দেখেনি। তবুও এই খবর শুনে সাধারণ মানুষ আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছে। এবার নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা তথা রাজাকার আলবদর বাহিনী পরাজিত হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। কিন্তু সেই স্বাধীনতার জন্য আর কত দিন আর কত রাত তাদের এমন দুঃসহ যাতনা ভোগ করতে হবে?

আজ ৩০শে জুন। জুন মাসের শেষ দিন। মানুষ জন সারা রাত গাঁ পাহারা দিয়ে ঘরে ফেরা শুরু করেছে। মসজিদে মসজিদে মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। ঠিক এমন সময় খাজুরিয়া রাজাকার ক্যাম্পের উপর যেন গুলির বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। এলএমজি, এসএলআর, ৩০৩ রাইফেলের গুলি ও গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দের পাশাপাশি মুর্হুমুহু ভেসে আসছে জয় বাংলা স্লোগান। তখন এলাকার মানুষের মনের সব সংশয় দূর হয়ে যায়। তারা নিশ্চিত হয়ে যায়, নরাধম রাজাকাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে মুক্তিযোদ্ধারাই খাজুরা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেছে। সারা ক্যাম্প এলাকায় যেন ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। সেই ভূমিকম্প যেন থামতেই চায় না। প্রায় ঘন্টা খানেক প্রবল গুলাগুলি চলার পর আস্তে আস্তে তা স্তিমিত হয়ে আসে। এরই মধ্যে পূর্ব আকাশে নতুন দিনের আশার সূর্য উদিত হতে দেখা যায়। দিনের আলোয় আশে পাশের বাড়িঘরের লোকজন ক্যাম্পের সামনে এসে দেখতে পায় ৫ জন রাজাকার মরে পড়ে আছে। বাকিরা জীবন বাঁচাতে ক্যাম্পের পিছনের ডোবায় আশ্রয় নিয়েছিল। মুক্তিবাহিনী চলে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে তারা ক্যাম্পে ফিরে আসছে। নরাধমদের এমন উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে দেখে গাঁয়ের লোকজন মনে মনে ভীষণ খুশি হলেও তারা মুখে তা প্রকাশ করতে পারে না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেদিনের রাতের খবরে যশোর জেলার খাজুরা রাজাকার ক্যাম্পের উপর মুক্তিযোদ্ধাদের সফল অপারেশন পরিচালনার খবর ফলাও করে প্রচার করার সাথে সাথে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বময়। এই খবর পেয়ে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিটা মুক্তিপাগল বাঙালির মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেদিনের চরমপত্র অনুষ্ঠানে শোনা গেল– বিচ্ছুদের গাবুড় মাইরের চোটে যশোরের খাজুরায় ৫ জন রাজাকার অক্কা পেয়েছে। বাকিরা জীবন বাঁচাতে ক্যাম্পের পেছনের ডোবার ভেতরে হাবুডুবু খেয়েছে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত