মত-অমত

মত-অমত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : বাংলা সাহিত্যের রাজাধিরাজ

“আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি বসি পড়িছ আমার কবিতাখানি
কৌতুহল ভরে—”

রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা সাহিত্য অচিন্তনীয়, অকল্পনীয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখনীতে বিশ্বসাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের যেটুকু অর্জন, তা অন্যকারো হাত দিয়ে সম্ভব হয়নি। আর তাই, বিশ্বসাহিত্যের মঞ্চে বাংলা ভাষাার মর্যাদাকে সর্বোচ্চ স্তরে তুলে ধরার একক কৃতিত্বটুকু তাঁরই, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাঁর রচিত কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ — বাংলা সাহিত্যে তাঁর রাজ্য এবং রাজত্ব, দুটোই আজো অক্ষুন্ন। আজও জ্ঞান পিয়াসী চাতকেরা তাঁর কাব্যরসের অমিয় সুধা পান করে চলেছেন। মদিরার নেশার মত তাঁর গানের সুরে

মাতাল হয়ে জীবনের সুখ খুঁজে নিচ্ছেন। এমনই এক চিরঞ্জীব সাহিত্যের স্রষ্টা তিনি।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য যেন একই সাথে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে আধ্যাত্মিকতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ দর্শনের চমৎকার মেলবন্ধন। একই সাথে মানব মর্যাদাকে সর্বাগ্রে ধারণ করে বলিষ্ঠ কন্ঠে স্রষ্টার প্রতি প্রার্থনায় তিনি বলে ওঠেন—

“চিত্ত যেথা ভয়শূণ্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর।”

আবার কত সুন্দর ভাবে তিনি একটা শিশুমনের কল্পনাকে কবিতায় তুলে ধরতে পারেন, তার প্রমাণ পাই বীরপুরুষ কবিতায় এভাবে—

“মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে,
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।”

কত সহজ-সরল অথচ কী গভীর মমতা দিয়ে তিনি ধারণ করেছেন কবিতার প্রতিটি কথা, প্রতিটি চরণ! এভাবে তিনি তাঁর রচনায় স্রষ্টাার প্রতি সৃষ্টির প্রেম, মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম, মায়ের প্রতি সন্তানের প্রেম এবং দেশপ্রেম—সবগুলোকে কাব্যের সুতোয় গেঁথে আমাদের বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে গেছেন বিশ্বসাহিত্যের কাতারে।

রবীন্দ্রনাথের গান সম্পুর্ণ বাংলা সাহিত্যে অনন্য। তাঁর গানে প্রেম, প্রকৃতি, আত্মান্বেষণ, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে। এসব গান আমাদের অন্তরকে স্পর্শ করে আমাদেরকে নতুন আলোর দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাঁর গানে আমরা যেভাবে একই সাথে প্রকৃতিপ্রেম, মানব প্রেম বা দেশপ্রেমকে পাই, তা পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সাহিত্যে বিরল। আমাদের জাতীয় সংগীতসহ অনেক দেশাত্ববোধক গানে যে মমত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন, তা অতুলনীয়।

“ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা॥”

কী উপলব্ধি! কী মায়া আর মমতা দিয়ে জড়িয়ে ধরা প্রতিটি কথা যেভাবে আমাদের দেহ মনে এক অবর্ণনীয় শিহরণ জাগায় তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?

একজন ছোট গল্পকার হিসেবেও তাঁর প্রতিটি গল্পই বিশ্বমানের। হৈমন্তী, অপরিচিতা,কাবুলিওয়ালা বা তোতা কাহিনী—প্রত্যেকটি গল্পের পটভুমি,চরিত্র,কাহিনী বিন্যাস এবং আকস্মিক সমাপ্তি যেন বলে দিচ্ছে , ‘শেষ হইয়া্ও হইলনা শেষ!’ তাঁর গল্প লেখনীর শক্তিশালী বুনটে আমরা তাঁর মাঝে পাই পাশ্চাত্য সাহিত্যিক জন মিল্টন, ও হেনরী, মার্জারি কিনান রলিং কিংবা উইলিয়াম সেক্সপিয়ারকে।

আবার আমরা যদি তাঁর রচিত নাটক গুলোর দিকে তাকাই তাহলে সেখানেও তাঁর মুন্সিয়ানার পরিচয় মেলে। তাঁর নাটক প্রধানত ভাবাত্মক, গীতিধর্মী এবং তত্ত্বচিন্তাবাহী। তাঁর নাটকে সমকাল সমাজ ও ব্যক্তিসমস্যার নানান জটিল অবস্থা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি সমকালীন সমাজ ও ব্যক্তির চরিত্রকে নাট্যরুপে চিত্রিত করেছেন কয়েক ভাবে। ‘গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য ও নাট্যকাব্য – এ তিন ধারায় রচিত নাটকগুলো বাংলা সাহিত্যের এক একটি অমূল্য সম্পদ।

বাংলা সাহিত্যের সমকালীন লেখকদের তুলনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা উপন্যাসের ভাষা ও কাহিনী বিন্যাস সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল হওয়ায় খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। ১৮৮৩ সাল থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যকার এই সময়কালে তিনি মোট ১৩টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন যার মধ্যে ’করুণা’ নামে তাঁর একটি অসমাপ্ত উপন্যাসও রয়েছে। ‘নৌকাডুবি’,’গোরা’,’ চতুরঙ্গ’ সহ প্রতিটি উপন্যাসই এখনও অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর লেখা ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসটি যেন মানব জীবন দর্শনের একটা সেরা উপাখ্যান। উপন্যাস গুলির পটভুমি, কাহিনী ও চরিত্র বিন্যাস সমসাময়িক হলেও বিশ্বসাহিত্যের মানদন্ডে সর্বজনীন। আর এভাবেই তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় নিপুণ স্রষ্টার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েই পদচারণা করেছেন সগৌরবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের রাজাধিরাজ। তিনি একাধারে একজন ভাষাবিদ, একজন অমর সংস্কৃতিবিদ, একজন দার্শনিক, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, অভিনেতা, শিক্ষাবিদ এবং একই সাথে একজন মানবিক সমাজকে আলোকিত করার পথ প্রদর্শক। তাঁর কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, ছোট গল্প, গদ্য রচনাবলী সবই বিশেষ ঔজ্জ্বলতা ও আধ্যাত্মিক সত্ত্বায় দ্যূতিময়। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকর্ম বাংলা সাহিত্যে এক একটি অমূল্য সম্পদ। প্রতিটি রচনা যেমন একদিকে মানুষের হৃদয়ে আলোকিত সত্যের সন্ধান দেয়, তেমনি প্রেম, স্বাধীনতা, প্রকৃতির সাথে একাত্মতা, মানুষের আন্তরিকতা ও মানব জীবনের প্রতিটি দিককে উদ্ভাসিত করে তোলে।

একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত দিয়ে বিশ্ব সাহিত্যেরভাণ্ডারে বাংলাভাষার যে সম্পদ গচ্ছ্বিত রাখা হয়েছে, তাতে যতদিন পৃথিবীতে বাঙালি ও বাংলা ভাষার অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন বিশ্ব সাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের অবদান চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

লেখক : শিক্ষক ও সাংবাদিক

 

বিষয়:
পরবর্তী খবর

বসুন্ধরা পারলে কেন সিটি করপোরেশন পারবে না

ভোররাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল। সারা রাত আকাশে মেঘ ছিল। আষাঢ় শেষ হয়ে আসছে। বর্ষাকাল। এখন এরকমই হওয়ার কথা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হবে হঠাৎ করেই। ঝুপ ঝুপ করে নামবে বৃষ্টি। কখনও থেকে থেকে, কখনও অবিরাম। এ বছরের বর্ষায় প্রবল বৃষ্টি হতে পারে, আবহাওয়াবিদরা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তন এখন পৃথিবীর সবচাইতে বড় সমস্যা। যেদিন আমরা পিছনে ফেলে এসেছি, যে আবহাওয়ায় বড় হয়েছি, সেই আবহাওয়া এখন আর নেই। শীতের দেশগুলোতে তীব্র গরম পড়ছে। শীতকালে শীত পড়ছে আগের তুলনায় বেশি। বরফের পাহাড় গলে যাচ্ছে আন্টার্টিকায়। দাবানলে পুড়ছে আমেরিকার বনভূমি। প্রকৃতি উল্টো-পাল্টা হয়ে গেছে। বদলে গেছে বহু কিছু।

এ বছরের গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। জীবজগৎ বিপর্যস্ত। আবহাওয়াবিদরা বলেছিলেন, বর্ষায় প্রবল বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। ক’দিন আগে তাই হলো। ভোররাত থেকে বৃষ্টি। সকাল দশটা এগারোটা পর্যস্ত থামার নাম নেই। আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ছায়াময় পরিবেশ। আমি একটু বেলা করে উঠেছি। মধ্যমাত্রার বৃষ্টি তখনও ঝরছে। দুপুর নাগাদ টেলিভিশন আর অনলাইনগুলো দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ঢাকা শহরের বহু এলাকা বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে। রিকশার পাদানিতে উঠে গেছে পানি। বাসের চাকা ডুবে গেছে। প্রাইভেটকার ডুবে গেছে, জেগে আছে শুধু গাড়ির ছাদটুকু। নিউমার্কেট আর কাঁটাবন এলাকার দোকানপাটের ভিতর কোমর পানি। ছোট আর মাঝারি ব্যবসায়ীরা পড়ে গেছেন ব্যাপক সংকটে। দোকানের মালামাল রক্ষা করতে পারেননি। সব ভেসে গেছে বৃষ্টিতে। শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে।

অন্যদিকে মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। কর্মস্থলে যাওয়া মানুষ, বাড়ি ফেরার মানুষ, ছাত্র-ছাত্রী প্রত্যেকেই পড়েছে চরম দুর্ভোগে। গাড়ি চলছে না। হেঁটে বাড়ি ফিরছে মানুষ। তাদের কোমরের ওপর পর্যন্ত পানি। পুরান ঢাকার অলিগলি রাজপথ ডুবে গেছে। ঘরে ঢুকে গেছে পানি। মানুষ দিশেহারা। এ অবস্থা কেমন করে সামাল দেবে? এক বেলার বৃষ্টিতে জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত। অথচ কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশনের জন্য। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বৃষ্টি হলেই ডুবছে রাস্তাঘাট। বিপাকে পড়ছে মানুষ। আবহাওয়াবিদদের সাবধানতা বা ভবিষ্যদ্বাণী সিটি করপোরেশন দুটো সেভাবে মনে রাখেনি। মনে রেখে আগাম ব্যবস্থা নিলে শহরবাসী এরকম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ত না। এই বিষয়ে দুই মেয়রের তীক্ষ্ণ নজর থাকা জরুরি ছিল। ঢাকার খালগুলো প্রায় সবই বুজে গেছে। দখল হয়ে গেছে। সবই আছে খালগুলোতে, শুধু পানিটাই নেই। পানির প্রবাহ বলতে কিছু নেই। ময়লা আবর্জনার ভাগাড় হয়ে গেছে একেকটা খাল। মেয়র মহোদয়দের দেখি, প্রায়ই খাল উদ্ধারের অভিযান করছেন। দু-একটা খাল দখল মুক্তও করছেন। তারপর আর খবর নেই। আগের মতো দখল হয়ে যাচ্ছে। আরেক মহাশত্রু হয়েছে পলিথিন। এই জিনিসের কোনও বিনাশ নেই। শুধুমাত্র পলিথিনই ডুবিয়ে দিচ্ছে অনেক অর্জন। এই বিষয়টি নিয়ে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সচেতন হওয়া জরুরি। পলিথিনের হাত থেকে বাঁচাতে হবে দেশ। পলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থা কাজে লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও মিডিয়া মিলে জনসচেতনা গড়ে তোলা জরুরি। মানুষ সচেতন হলে সমাজ পরিশিলিত হয়। গত তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা। এখন বসুন্ধরা ঢাকার সবচাইতে অভিজাত এলাকা। সবচাইতে আকর্ষণীয় এলাকা। বসুন্ধরায় কারও একটি ফ্ল্যাট বা কারও এক টুকরো জমি থাকলে তিনি খুব গৌরববোধ করেন। বসুন্ধরার মতো সুবিন্যস্ত আবাসিক এলাকা ঢাকায় আর নেই। এলাকাটির পরিকল্পনা করা হয়েছে সম্পূর্ণতই ইউরোপ-আমেরিকার ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর লাগোয়া অতি আধুনিক আবাসিক শহরগুলোর মতো করে। সুপরিকল্পিত ও সুব্যবস্থাপূর্ণ। বড় বড় রাস্তা। রাস্তার ধার আর আইল্যান্ডগুলো সবুজ গাছপালায় ভর্তি। রাজউকের বিল্ডিংকোড মেনে নির্মিত প্রতিটি বাড়ি। সঙ্গে আছে বসুন্ধরার নিজস্ব কঠোর তদারকি। নিয়মের বাইরে একটি ইটও বসানো যাবে না। একটি গাছের পাতাও ছেঁড়া যাবে না। অন্যদিকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুরুষমানুষরা তো বটেই, নারী ও শিশুরা চাইলেও রাত দুপুরে বাড়ির বাইরে বেড়াতে বেরোতে পারে। ডিস্টার্ব করা তো দূরের কথা, চোখ তুলেও তাকাবার সাহস পাবে না কেউ। নিরাপত্তায় নিয়োজিত গাড়িভর্তি কর্মী চব্বিশঘণ্টা টহল দিচ্ছে। ঢাকার ভিতরেই বসুন্ধরা সম্পূর্ণ এক আলাদা জগৎ। স্বপ্নের বাসভূমি। এটা সম্ভব হয়েছে সুপরিকল্পনা ও তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন আর প্রয়োগের ফলে। গত কয়েক বছর আগে বর্ষার বৃষ্টিতে বসুন্ধরার কোথাও কোথাও পানি জমে যেত। এই নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন কর্তৃপক্ষ। সুদূর প্রসারী আধুনিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে রাতারাতি সামাল দিলেন সেই সমস্যা। গড়ে তুললেন অত্যাধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা। যত বৃষ্টিই হোক, বসুন্ধরায় এখন আর পানি জমে না। জোরালো ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে বৃষ্টির পানি এক মিনিটও দাঁড়াতে পারে না। সঙ্গে আছে এলাকার ড্রেনগুলোর সঠিক তদারকি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বহুকর্মী নিয়োজিত এই কাজে। কী নেই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়? হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, খেলার মাঠ, শপিং মল, সুন্দর সুন্দর মসজিদ, গোরস্থান, অতি আধুনিক সব রেস্টুরেন্ট। এক কথায় সব মিলিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা বর্তমান বিশ্বের অতি আধুনিক এক মনোরম শহর। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা নিয়ে কথাগুলো বলার কারণ, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র মহোদয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বসুন্ধরায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার অনুকরণ করে তাঁরা খুব সহজেই হঠাৎ বৃষ্টিতে জলাবদ্ধ হয়ে যাওয়া ঢাকা শহরকে অনেকখানি মুক্তি দিতে পারেন। মানুষকে দুর্ভোগ মুক্ত করতে পারেন, ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে পারেন ক্ষতির হাত থেকে। ছাত্র-ছাত্রী আর পথচলা মানুষদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে পারেন। বৃষ্টির তোড়ে হঠাৎ অসহায় হয়ে পড়া গৃহবাসীদের সুরক্ষা দিতে পারেন। এই শহরের মানুষকে স্বস্তিতে বসবাস করার সুযোগ করে দিতে পারেন। এসব তাঁদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয় তাঁরা ভাববেন। তাঁদের চোখের সামনেই তো উদাহরণ হিসেবে আছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা।

পরবর্তী খবর

নজরুল জয়ন্তী আয়োজন ২০২৪

নজরুল ইসলাম : বাঙালির কবি

[নজরুলকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি ঘোষণার যৌক্তিকতা কিংবা অদ্যাবধি এ বিষয়ে কোনো সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে কি হয়নি, সমালোচক বিশেষের তোলা এসব বিতর্কে না গিয়ে, এমনকি “বাংলাদেশী” জাতীয়তার অর্থে নয় — বৃহত্তর বাঙালিত্বের ধারণা থেকেই, তিনি কেন আমাদের ‘জাতীয় কবি’, সেটাই লেখক সংক্ষেপে এ প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনাকে আমরা স্বাগত জানাবো।]

সুভাষচন্দ্র বসু ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার তৎকালীন এ্যালবার্ট হলে নজরুল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন : “আমরা যখন যুদ্ধে যাবো — তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাবো, তখনও তাঁর গান গাইবো।” নজরুল প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের এই উক্তিটি বহু-উদ্ধৃত। সুভাষচন্দ্র তাঁর ওই ভাষণে নজরুল সম্পর্কে একাধিকবার ‘জ্যান্ত মানুষ’ কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। এ কথার দ্বারা তিনি নজরুল প্রতিভার ‘প্রাণময়তা’র কথা বোঝাতে চেয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, “আমাদের প্রাণ নেই তাই আমরা এমন প্রাণময় কবিতা লিখতে পারি না।” তাঁর মতে সাহিত্যে জীবনকে, যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাকে নজরুলের মতো করে অন্তত তখন পর্যন্ত এদেশে আর কেউই প্রতিফলিত করতে পারেননি। এই না-পারার কারণ, সুভাষচন্দ্র বলেছেন, দেশের পরাধীনতা। তার মানে কথাটা দাঁড়াচ্ছে, পরাধীন দেশেও নজরুল ছিলেন একজন মুক্তপ্রাণ মানুষ। সাহিত্যে জীবনের এই প্রতিফলন, প্রাণের এই স্পর্শের কারণেই নজরুলের লেখার প্রভাব হয়েছে ‘অসাধারণ’। আর তা এতই অসাধারণ যে, সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, “তাঁর গান পড়ে আমার মতো বেরসিক লোকেরও জেলে বসে গাইবার ইচ্ছা হতো।” নজরুলের ‘দুর্গম গিরি’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে অভিহিত করে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, “আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই। প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সংগীত শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মতো প্রাণ-মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না।” তবে উক্ত ভাষণ সুভাষচন্দ্র শেষ করেছিলেন খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটি মন্তব্য দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, নজরুলের স্বপ্নটা ‘সমগ্র বাঙালি জাতির স্বপ্ন’। (মান্নান : ৫৪) এ কথার দ্বারা সুভাষচন্দ্র অনেকদিন আগেই বাঙালির জাতীয় কবি হিসেবে নজরুলের প্রতি স্বীকৃতি ঘোষণা করে গেছেন। বলা বাহুল্য হিন্দু-মুসলমান উভয় সংস্কৃতির উপাদানে গঠিত যে বাঙালিত্ব, সে অর্থেই নজরুলকে ‘সমগ্র বাঙালি জাতি’র স্বপ্নদ্রষ্টা বলেছিলেন তিনি।

অন্যদিকে বাঙলার আরেক বিশিষ্ট নেতা বিপিনচন্দ্র পাল, যিনি ছিলেন প্রচণ্ড রকমে রবীন্দ্রবিরোধী, চিত্তরঞ্জন দাশের নারায়ণ পত্রিকায় রবীন্দ্রবিরোধী প্রচারণার ক্ষেত্রে যাঁর ছিল বলতে গেলে কাণ্ডারির ভূমিকা, রবীন্দ্রসাহিত্যের ব্যাপারে যাঁর একটা বড় অভিযোগ ছিল যে দেশের মাটির সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই, নজরুলের কবিতায় তিনি মাটির গন্ধ খুঁজে পেয়েছিলেন; বলেছিলেন, “এ খাঁটি মাটি হইতে উঠিয়াছে”। আর এ-প্রসঙ্গে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, কিছুটা অশোভনভাবেই তাঁর ঠাকুরদাকে অবধি টেনে এনে বঙ্গবাণী পত্রিকায় (১৮ জুন ১৯২৩) বিপিন পাল লিখেছিলেন, “আগেকার কবি যাঁহারা ছিলেন তাঁহারা দোতলা প্রাসাদে থাকিয়া কবিতা লিখিতেন। রবীন্দ্রনাথ দোতলা হইতে নামেন নাই। কর্দমময় পিচ্ছিল পথের উপর পা পড়িলে কেবল তিনি নন, দ্বারকানাথ ঠাকুর পর্যন্ত শিহরিয়া উঠিতেন।” নজরুলকে বিপিন পাল ‘নতুন যুগের কবি’ এবং তাঁর কবিতায় ‘দেশে যে নতুন ভাব জন্মেছে তার সুর’ পাওয়ার কথা বলেছিলেন। (মান্নান : ৫৫)

আর প্রফুল্লচন্দ্র রায় পূর্বোক্ত এ্যালবার্ট হলের সংবর্ধনা সভায়ই তাঁর সভাপতির ভাষণে নজরুলকে ‘প্রতিভাবান মৌলিক কবি’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছিলেন, “তিনি বাংলার কবি, বাঙালির কবি।” এবং “কারাগারে শৃংখল পরিয়া বুকের রক্ত দিয়া তিনি যাহা লিখিয়াছেন তাহা বাঙালির প্রাণে এক নতুন স্পন্দন জাগাইয়া তুলিয়াছে।” প্রফুল­চন্দ্র রায় এ প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের আওতায় নজরুলের প্রতিভা পরিপুষ্ট হয় নাই। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁহাকে কবি বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন।” (মান্নান : ৫৩) বস্তুত রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে কেবল কবি বলে স্বীকারই করেননি, (পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় যদি ভুলভাবে উদ্ধৃত করে না থাকেন), তাঁর রচনাকে এমন কি ‘মহাকাব্য’ বলেও অভিহিত করেছিলেন। নজরুল-প্রতিভা সম্পর্কে আপন ভক্ত-অনুরাগী মহলের ‘কিছু সন্দেহ’র জবাব দিতে গিয়ে তিনি যা বলেছিলেন তা এ-প্রসঙ্গে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য :

“… নজরুলকে আমি ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গপত্রে তাকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করেছি। জানি, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারোনি। আমার বিশ্বাস, তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও রূপ ও রসের সন্ধান করোনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।”

নজরুলের কবিতায় সমসাময়িকতার প্রভাব ও/বা তার চড়া সুর (নিশ্চয় নজরুলের সব কবিতা সম্পর্কে কথাটা প্রযোজ্য নয়) যাঁদেরকে তাঁর রচনার কাব্যমূল্য বা স্থায়িত্ব সম্পর্কে সন্দিহান রেখেছিল তাঁদের সে সন্দেহ বা অভিযোগ নাকচ করে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন :

“কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এসব তোমাদের অবদার বটে। সমগ্র জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করবে বৈকি! আমি যদি আজ তরুণ হতাম তাহলে আমার কলমেও ঐ সুর বাজত।” (মান্নান : ৫১)

২.

জীবনানন্দ দাশ, অনেকেরই বিচারে রবীন্দ্রপরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠতম প্রতিভা যিনি, নিজে অভিহিত হয়েছেন কখনো ‘নির্জনতম’ আবার কখনো ‘শুদ্ধতম’ কবি হিসেবে, নজরুলের কবিতা সম্পর্কে যাঁর মূল্যায়ন ‘চমৎকার কিন্তু মানোত্তীর্ণ নয়’, তিনিও নজরুলের কাব্য-সাধনার ‘অসার্থকতা’র জন্য যতটা না তাঁর প্রতিভার বৈশিষ্ট্যকে তার চেয়ে বেশি যুগ-পরিবেশকে, জনরুচির ‘অনুত্তীর্ণত’াকে দায়ী করেছেন। তাঁর ‘নজরুল ইসলাম’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করা যাক :

“জনগণ তখন আজকের মত ঈষৎ উন্নত কিংবা রূপান্তরিত? [য.প্রা.] — ছিল না; চমৎকার কবিতা চাচ্ছিল, (আজো জনমানস রকমফেরে তাই-ই চায় যদিও); নজরুল সেই মন স্পর্শ করতে পেরেছিলেন এমনভাবে যে আজকের কারও কোনো জনসাধারণের জন্যে তৈরী কবিতা বা গদ্যকবিতা ফলত পদ্যের স্তরে নেমেও তা পেরেছে কিনা বলা কঠিন। তখনকার দিনে বাংলায় লোকোত্তর পুরুষ কম ছিলেন না — শ্মশানের পথে সন্তানোৎসব জমেছিল বেশ খানিকটা ঔদাত্ত্যে। নজরুল ইসলামের আগ্রহ পুষ্ট হয়েছিল, তিনি অনেক সফল কবিতা উৎসারিত করতে পেরেছিলেন। কোনো-কোনো কবিতায় এতো বেশি সফলতা যে কঠিন সমালোচকও বলতে পারেন যে নজরুলী সাধনা এইখানে-এইখানে সার্থক হয়েছে; — কিন্তু তবুও মহৎ মান এড়িয়ে গিয়েছে। কোনো এক যুগে মহৎ কবিতা বেশি লেখা হয় না। কিন্তু যে বিশেষ সময়ধর্ম, ব্যক্তিক আগ্রহ ও একান্ততার জন্যে নজরুলের অনেক কবিতা সফল ও কোনো-কোনো কবিতা সার্থক হয়েছিল — জ্ঞানে ও অভিজ্ঞতায় মূল্য-ও-মাত্রা-চেতনায় খানিকটা সুস্থির হয়েও আজকের দিনের অনেক কবিতাই যে সে তুলনায় ব্যাহত হয়ে যাচ্ছে তা শুধু আধুনিক বিমুখ সময়রূপের জন্যেই নয় — আমাদের হৃদয়ও আমাদের বিরূপাচার করে, অনেক সময়ই আমাদের মনও আমাদের নিজেদের নয়; এই সাময়িকতার নিয়মই হয়তো তাই। কিন্তু ব্যক্তিকতা নজরুলের ও সময় এই বুদ্ধিসর্বস্বতার হাত থেকে তাঁকে নিস্তার দিয়েছিল।” (ফয়জুল : ১০৩)

উদ্ধৃতিটা বেশ দীর্ঘ হয়ে গেল। কারণ এর অভাবে জীবনানন্দের বক্তব্যের মর্মার্থ উপলব্ধিতে আমাদের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা। আমরা জানি কাব্য বিচারে জীবনানন্দের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় শুদ্ধতাবাদীর। কবিতায় মানুষ বা সমাজের প্রতি দায়বোধ কিংবা তাঁর নিজের ভাষায় ‘চিন্তা ও সিদ্ধান্ত, প্রশ্ন ও মতবাদ’ তাঁর মতে ততটা পর্যন্ত অনুমোদনযোগ্য যতক্ষণ তা ‘সুন্দরীর কটাক্ষের পিছনে শিরা, উপশিরা ও রক্তের কণিকার মতো লুকিয়ে থাকে’। (’কবিতার কথা’) নজরুলকে তিনি যে কোথাও কোথাও সফল এমন কি সার্থক ভেবেও চূড়ান্ত বিচারে অসার্থক বিবেচনা করেছেন সে তাঁর কাব্য বিচারের ওই মানদণ্ড থেকেই। এবং হয়তো নজরুলের কাব্যসাধনার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় লাভের সুযোগ ছাড়াই।১ নজরুলকে তিনি শেষাবধি বাংলা কাব্যের আবহমান ধারায় লালিত, বিশেষ করে রবীন্দ্র ঐতিহ্যের ‘আবহপুষ্ট’ ও ‘সেই পরিমণ্ডলেরই অন্তর্লীন একজন কবি’ হিসেবে দেখেছেন, যিনি ‘যেখানে-যেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতিকে অতিক্রম করেছেন’ সেখানেও ‘এমন কোনো নতুন সূচনালোকে পৌছুতে পারেন নি, যার থেকে সত্যিই একটা স্বতন্ত্র ঐতিহ্য (কবিতার) সৃষ্টি হতে পারে’। ‘আধুনিকতা’, ‘বৈদগ্ধ্য’, কাব্যবোধ বা রুচি ইত্যাদি সম্পর্কে যুদ্ধোত্তর পশ্চিমী ধারণাকে প্রায় স্বতঃসিদ্ধজ্ঞানে গ্রহণ করার ফলেই এলিয়ট ও ইয়েটসের সঙ্গে নজরুলের ‘আশ্চর্য আবশ্যিক পার্থক্য’ জীবনানন্দকে নজরুলের কবিতা সম্পর্কে কতিপয় নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্ররোচিত করেছে। তারপরও এ-প্রসঙ্গে জীবনানন্দের মন্তব্য : “কাজী নজরুল যদি ইউরোপীয় সাহিত্যের রীতি ও পরিণতির নিকট কোনো দিক দিয়ে ঋণী থাকেন, তা’হলে তা অনেকটা মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথের মধ্যস্থতায়। এ রকম পটভূমি বেছে নিতে হলে আধুনিকতর কবিদের শ্বাস আটকে আসত; কিন্তু নজরুল ইসলামের পক্ষে রবীন্দ্র-পরিস্রুত বিদেশী কাব্যেরও ততটা দরকার ছিল না — আধুনিক বাংলাদেশে তিনি বাংলার মাটিরই বিশেষ স্বায়ত্ত সন্তান বলে। আজকের বাংলার অন্য কোনো কবি সম্পর্কে এ-কথা বলা চলে না হয়তো। তাঁরা অনেকেই তাঁদের বিমুক্ত পরিব্রাজক সত্তাকে সংহত করেই বাঙালি।” (‘কবিতা পাঠ : দুজন কবি’) নজরুলের কবিতার স্থায়িত্ব বা মহত্ব নিয়ে তাঁর ঘোরতর সংশয়ী অবস্থান সত্ত্বেও জীবনানন্দ তাঁর বক্তব্য শেষ করেছেন এই স্বীকৃতি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে :

“বাংলার এ মাটির থেকে জেগে, এ মৃত্তিকাকে সত্যিই ভালোবেসে আমাদের দেশে উনিশ শতকের ইতিহাসপ্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়তাবাদী কবি নজরুল ইসলাম। তাঁর জনপ্রেম, দেশপ্রেম, পূর্বোক্ত শতাব্দীর বৃহৎ ধারার সঙ্গে সত্যিই একাত্ম। পরবর্তী কবিরা এ সৌভাগ্য থেকে অনেকটা বঞ্চিত বলে আজ পর্যন্ত নজরুলকেই সত্যিকারের দেশ ও দেশীয়দের বন্ধু কবি বলে জনসাধারণ চিনে নেবে। জন ও জনতার বন্ধু ও দেশপ্রেমিক কবি নজরুল।” (ফয়জুল : ১০৯)

বুদ্ধদেব বসু, বাংলা আধুনিক কাব্য সমালোচক হিসেবে তাঁর স্থান নিঃসন্দেহে শীর্ষে, তো প্রায় কিশোর বয়সে প্রথমে মাসিকপত্রে ছাপার অক্ষরে ‘বিদ্রোহী’ এবং তারপর ‘নোয়াখালির রাক্ষসী নদীর আগাছা-কণ্টকিত কর্দমাক্ত’ পাড়ে বসে কলকাতা-আগত এক মুসলমান যুবকের খাতায় কপি করা নজরুলের ‘আরো অনেকগুলি’ কবিতা পড়ে তাঁর সেই যে বিস্ময়-বিমুগ্ধতা তা তিনি পরে কাটিয়ে উঠেছিলেন সত্যি। কিন্তু নির্মোহ দৃষ্টিতে নজরুল বিচার করতে গিয়ে তিনি এ-পর্যায়ে যা লিখেছেন তা-ও যেন ভারসাম্যহীন ও আগাগোড়া স্ববিরোধিতায় পূর্ণ। নজরুলের প্রভাব তাঁর সময়ে ‘বোধহয় রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল’২ এবং ‘নজরুল সম্বন্ধে বিশেষভাবে বলবার কথা এইটেই যে তিনি একই সঙ্গে লোকপ্রিয় কবি ও ভালো কবি’ ইত্যাকার বাক্যের পাশেই কিংবা তার কিছু পরেই আবার তাঁর মন্তব্য : ‘একটি দুটি স্নিগ্ধ কোমল কবিতা ছাড়া [নজরুলের] প্রায় সবই ভাবালুতায় আবিল, অনর্গল অবচেতন বাক্যবিন্যাসে প্রায় অর্থহীন’। কখনো কিপলিংয়ের সঙ্গে (‘কোলাহলকে গানে বাঁধা’, লেখায় ‘শুধুই হৈ-চৈ আছে, কবিত্ব নেই’) আবার কখনো বায়রনের সঙ্গে (‘… সেই উচ্ছৃঙ্খলতা, আতিশয্য, শৈথিল্য, সেই রসের ক্ষীণতা, রূপের হীনতা, রুচির স্খলন’) নজরুলের প্রতিভা বা কবিস্বভাবের সাদৃশ্য টেনে বুদ্ধদেব বসু যা বলতে চেয়েছেন তা হল, নজরুলের কাব্যসাধনায় ‘কোনো পরিণতির ইতিহাস পাওয়া যায় না’, বছরের পর বছর তিনি ‘একই রকম’ লিখে গেছেন, কখনো নিজেকে অতিক্রমের চেষ্টা করেননি। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উক্তি ধার করে বুদ্ধদেব আরও বলেছেন, নজরুলের প্রতিভা ‘ধনী, কিন্তু গৃহিণী নয়’। (বুদ্ধদেব : ৯০-৯১)

নজরুলের সমস্ত সৃষ্টির সারিতে তাঁর গানগুলিকেই বরং সবচেয়ে সার্থক ও স্থায়িত্বের দিক থেকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বলে বুদ্ধদেব বসুর মনে হয়েছে। আর এই গানের মধ্যে নজরুলের বীরত্বব্যঞ্জক বা স্বদেশপ্রেমমূলক গানগুলোকে তাঁর মনে হয়েছে সেরা (এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পরে ও ‘সম্ভবত দ্বিজেন্দ্রলালের উপরে’ নজরুলের স্থান নির্দেশ করেছেন বুদ্ধদেব বসু), ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’কে বলেছেন ‘উৎকর্ষের শিখরস্পর্শী’। বুলবুল ও চোখের চাতক-এর কিছু গান সম্পকের্ও তাঁর মšতব্য : ‘অনিন্দ্য বললে অত্যন্ত বেশি বলা হয় না’। কিন্তু এই বক্তব্যের অব্যবহিত পরেই আবার নজরুলের বাকি গানগুলো সম্পর্কে ‘দুরতিক্রম্য রুচির দোষে’র অভিযোগ তুলে বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, “শুধু যদি এই দোষ না থাকতো, শুধু যদি তাঁর রুচি হ’তো পরিশীলিত, তাহলে তাঁর মধ্যে একজন মহৎ গীতিকারকে আমরা বরণ করতে পারতাম।” (বুদ্ধদেব : ৯১) তারপরও এই ‘অসার্থক’ কবি কিংবা মহৎ-গীতিকার হবার সম্ভাবনা নিয়েও হতে-না-পারা (!) নজরুল সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর রায় :

ক. … পঁচিশ বছর ধ’রে তিনি আমাদের যা দিয়েছেন, সেই তাঁর অজস্র কাব্য ও সংগীত বাঙালির মনে তাঁকে স্মরণীয় ক’রে রাখবে। (বুদ্ধদেব : ৮৯)

খ. ‘বিদ্রোহী’ কবি, ‘সাম্যবাদী’ কবি কিংবা ‘সর্বহারা’র কবি হিশেবে মহাকাল তাঁকে মনে রাখবে কিনা জানি না, কিন্তু কালের কণ্ঠে গানের যে মালা তিনি পরিয়েছেন, সে মালা ছোটো কিন্তু অক্ষয়। … শুধু বাংলা কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে তাঁর আসন নিঃসংশয়, কেননা তাঁর কবিতায় আছে সেই বেগ, যাকে দেখামাত্র কবিত্বশক্তি ব’লে চেনা যায়। (বুদ্ধদেব : ৯২)

৩.

আপন রচনার শিল্পসার্থকতা বা তার স্থায়িত্ব নিয়ে নজরুল কিন্ত মোটেও ভাবিত ছিলেন না। যুগের নকিব তিনি, ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় কৈফিয়তের সুরে যথার্থই বলেছেন :

বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি !
কেহ বলে, তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে !
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী !

বলেছেন, ‘অমর কাব্য তোমরা লিখিও …’, এবং

পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।

৪.

‘পৃথিবীর কবি’ হিসেবে তাঁর ‘স্বরসাধনায় বহুতর ডাক না পৌঁছানো’র — ‘ফাঁক রয়ে যাবা’র কথা রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করে নিয়েছেন। ‘ঐকতান’ কবিতায় আপন ‘সুরের অপূর্ণতার নিন্দা’ মেনে নিয়ে বলেছেন, ‘আমার কবিতা, জানি আমি,/গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী’। সাহিত্যের আনন্দের ভোজে নিজে যা দিতে পারেননি এমন কি তার ‘খোঁজে থাকা’র কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রযুগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের সে অপূর্ণতা পূরণে নজরুলের ভূমিকাই যে প্রথম ও প্রধানতমের, এ সত্য অস্বীকার করবে, কার সাধ্যি?

নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শেষ বাক্যগুলোর অনুসরণে আমরাও যেন বিশ্বাস করেছি, যবেতক ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে’ ধ্বনিত হবে, ‘অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ’ উদ্যত থাকবে, নজরুলের কবিতার আয়ু বা আবেদন আসলে ততদিনই। আশা আমরা নিশ্চয় করব, স্বপ্ন দেখব এক সুন্দর সুদিনের যেদিন নজরুলের কবিতা সত্যিসত্যিই তার লড়াকু আবেদন খুইয়ে বসবে। কিন্তু সেদিন কবে আসবে? আদৌ কখনো আসবে কি? এদেশে বা পৃথিবীর কোথাও এমন সমাজ কি কখনো কায়েম হবে যেখানে কোনো রকম শোষণ-বঞ্চনা, বৈষম্য-বিভেদ, অন্যায়-উৎপীড়ন থাকবে না; কায়েমি স্বার্থ নামক বিষয়টির চির অবসান ঘটবে? সে সম্ভাবনা কি অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে আজ আরও দূরপরাহত বলে মনে হচ্ছে না? এ কারণেও নজরুল আরও বহুদিন আমাদের যুদ্ধসঙ্গী, তাঁর কবিতা-গান আমাদের অপরিহার্য রণবাদ্য-রণসঙ্গীত।

৫.

রবীন্দ্রনাথের সব কবিতা যে তাঁর সময়েও সব পাঠকের ভালো লাগতো তা তো নয়। আর আজকের দিনে তাঁর অনেক কবিতাই হয়তো প্রকৃত কাব্যামোদীদেরও আগ্রহ কাড়তে ব্যর্থ হবে। ব্যক্তির কাব্যবোধ বা অনুভূতির কথা বাদ দিলে এক্ষেত্রে পরিবর্তিত যুগরুচিরও একটা ভূমিকা আছে। কবিতা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য সাহিত্যসৃষ্টির বেলায়ও একথা প্রযোজ্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে বাংলা কবিতায় যুগান্তর ঘটিয়েছেন, তাঁর নানা সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে অন্তত একশো বছর এগিয়ে দিয়ে গেছেন, বাঙালির চিন্তা ও মননে সুগভীর ও স্থায়ী একটা প্রভাব সৃষ্টি করেছেন, এটা তো ঐতিহাসিক সত্য। এ কারো স্বীকার বা অস্বীকারের অপেক্ষা রাখে না। অর্থাৎ, আমরা বলতে চাইছি, লেখক বা সাহিত্যিকের ভূমিকা কেবল সৌন্দর্য সৃষ্টির দিক থেকে নয়। কিংবা হয়তো তার মাধ্যমেও তাঁরা আসলে জাতির মননচর্চা তথা সামাজিক বিকাশে একটা ভূমিকা রাখেন। সে ভূমিকাটা ঐতিহাসিক। পৃথিবীর সব বড় কবি-লেখক-শিল্পী সম্পর্কেই কথাটা কমবেশি খাটে। নজরুলের আবির্ভাবের আগে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের ভূমিকা ছিল প্রায় অধমর্ণের। বাঙলার জনসংখ্যার অর্ধেক বা তার বেশি হয়েও তাঁরা জানতো বাংলা সাহিত্যের কাছে তাদের নেয়ার মতো যদি বা কিছু থাকে, দেয়ার বিশেষ কিছু নেই। এ ব্যাপারে নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কেও তারা ছিল সন্দিহান। বাঙালি মুসলমানের এই হীনম্মন্যতা দূর করে তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস সঞ্চারের ক্ষেত্রে যে-দুজনের ভূমিকা মুখ্য তাঁদের একজন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও অন্যজন কবি নজরুল ইসলাম। এর মধ্যে প্রথমজন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিদের দান সম্পর্কে তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্য উপস্থাপন ও দ্বিতীয়জন তাঁর মৌলিক কাব্যসৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের শরিকানা নিশ্চিত করেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বাঙালি মুসলমানের দান ও অধিকার যে গৌণ বা উপেক্ষা করবার মতো নয়, সত্যি কথা বলতে নজরুলের পরই বাঙালি মুসলমান প্রথম বুক ঠুকে সে কথা বলার সাহস অর্জন করে। এর ফলে দেখা যায়, অন্যদের কথা বাদ দিলেও, বিংশ শতাব্দীতে বাঙালি মুসলমান লেখকদের মধ্যে মুক্তবুদ্ধিচর্চার পথিকৃৎ হিসেবে যাঁদের নাম স্মরণ করতে হয় তাঁদের প্রায় সবাই (কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল) তাঁদের আদর্শ বা সাহিত্যসৃষ্টির প্রেরণা হিসেবে ব্যতিক্রমহীনভাবে ও একবাক্যে নজরুলের নামোচ্চারণ করেছেন।

১৯২০ এর দশকের শেষ অবধিও শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে সংগীত চর্চা জায়েজ কি না তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক অব্যাহত ছিল। আকরম খাঁ প্রমুখকে এ সময় পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে সঙ্গীতচর্চা যে ইসলামে হারাম নয় তা প্রমাণের চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু তাতে যে আশু কোনো ফল দর্শেছে তা নয়। এ পর্যায়ে নজরুল এলেন, এবং আসার সঙ্গে সঙ্গে যাকে বলে জয় করলেন। শ্যামা সঙ্গীত ও কীর্তনের পাশাপাশি তিনি ইসলামি পুরাণ-ইতিহাস, মুসলিম উৎসব-পর্ব, ধর্মীয় পুরুষ ও ঐতিহাসিক চরিত্রদের নিয়ে একের পর এক ‘ইসলামি গান’ — হামদ-নাত, গজল ইত্যাদি লিখে চললেন, তারপর কে মল্লিক-আব্বাসউদদীন প্রমুখ এমন কি ছদ্মনামে অনেক হিন্দু শিল্পীকে দিয়েও তা রেকর্ড করালেন। এভাবে বাঙালি মুসলমানের ঘরে ঘরে তিনি সঙ্গীতের প্রবেশাধিকার ঘটিয়ে দিলেন। তাঁর আগে তো নয়ই, পরেও আর এতটা ব্যাপকতায় ও সফলতার সঙ্গে কে এ কাজটি করতে পেরেছেন? শুধু কি তাই? তাঁর ইসলামি গানের জনপ্রিয়তা এমন যে সে গানের কথায় খোদাপ্রেমকে (নিষিদ্ধ পানীয়) শরাবের সঙ্গে তুলনা করেও তিনি ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে তাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারলেন। এ শিল্পের শক্তি বৈ তো নয় ! নজরুলের এ সাফল্যের দিকটি, তাঁর এ ঐতিহাসিক ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করার সামর্থ্য যদি জীবনানন্দ দাশ বা বুদ্ধদেব বসু দেখাতে না পেরে থাকেন তবে তার জন্য তাঁদেরকে আমরা খুব বেশি দোষ দেব না। তবে প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা থেকে শুরু করে তাঁর রচনাবলির বিরাট অংশ জুড়ে যেভাবে ও যতটা দক্ষতার সঙ্গে তিনি হিন্দু ও মুসলমান বাঙলার এ দুটি প্রধান ধর্ম-সম্প্রদায়ের পুরাণ ও ঐতিহ্যকে পাশাপাশি ঠাঁই করে দিয়েছেন, যেভাবে সাংস্কৃতিক সমন্বয় ঘটিয়েছেন, আমরা যদি সত্যিসত্যি হিন্দু-মুসলমান মিলিত অর্থে বাঙালি জাতীয়তা ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হই, তবে নজরুলকে শুধু বাংলাদেশের নয়, বাঙালির জাতীয় কবির সম্মান আমাদের দিতেই হবে।

তথ্যসূত্র :

আবদুল মান্নান সৈয়দ (সম্পা.), কাজী নজরুল ইসলাম জন্মশতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ, ঢাকা : ২০০১
ফয়জুল লতিফ চৌধুরী (সম্পা.), জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধ সংগ্রহ, ঢাকা : ১৯৯৫
বুদ্ধদেব বসু, প্রবন্ধ-সংকলন, কলকাতা : ১৯৬৬

(২০১২)

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, ইতিহাসবিদ

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত