বইয়ের খবর, শিল্প-সাহিত্য

বইয়ের খবর, শিল্প-সাহিত্য

কিভাবে লিখলাম ‘কাঁটাতারের পরিযান’

২০১০সাল থেকেই ঢাকা থিয়েটারের সাথে জড়িত। ছোট খাটো ডায়লগ লেখা, নাটক গুছিয়ে লেখা এসব করতেই করতে বই নিয়েই সময় কাটতো ঢেরবেশি। বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা আর শখের ছবি আঁকার পাশাপাশি কিছু কিছু লেখা যেনো আসতে শুরু করলো ভেতর থেকে। কতশত কবিতা লিখিয়ে নিলো প্রেমিকেরা, কিছু লিখতাম প্রেমের শুরুতে আর কিছু লিখতাম প্রেমের শেষে। ওই যাকে বলে বিরহে। আমার ভেতর এই দুইধারি তালোয়ারের খোঁজ আমিও তখন পাইনি সত্যি। কিন্তু বইয়ের ভেতর, খাতার মাঝে, ব্যাগে একটা ডায়েরি থাকবেই থাকবে আমার তা যেনো ছিলো বাধ্যতামূলক। যেখানেই যা দেখতাম তা নিয়ে যেনো কিছু লিখে ফেলা, কিছু বলতে চাওয়া। কিন্তু আমাদের সমাজে মুখে কুলুপ এঁটে থাকায় যেখানে রীতি সেখানে লিখবো কী আমি আর ভারি!

ইউনিভার্সিটির শেষের দিকের কথা হবে। হাস্যরসিক এক বান্ধবী ছিল আমার, নাম জেরিন। সেই সময় তাদের বাসায় যাওয়া, উঠাবসা খুব হতো। ভালো পরিবার ছিলো তাদের। বলতে গেলে বনেদী ব্যাপারটা আমি প্রথম ওই বাসাতেই দেখি। যেমন রূপোর বাটিতে খাবার দেয়া, কাঁসার গ্লাসে পানি দেয়া। সংসারের চারদিক ঝলমল করছে কাঁসার সোনালি রঙে আর রুপোর ছিটকে আসা উজ্জ্বলতায়। ওসব দেখে আমরা অভ্যস্ত নই বলেই আমাদের আগ্রহ একটু বেশিই ছিল বৈকি জেরিনকে নিয়ে।

ক্লাস সেরে বা ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের আড্ডাটা হতো সিদ্ধেশ্বরী পি.বি.এস-এর ভেতর অথবা বাইরে। কয়েকমাস ধরেই খেয়াল করলাম জেরিন আর সেই আড্ডায় আসে না। নতুন প্রেম হয়েছে দেখে সবাই হাসাহাসি আর রসিকতা করেই অগ্রাহ্য করলাম আপাতত। সেমিস্টার ফাইনাল চলে আসলো, জেরিনের পাত্তা নাই। অনেকেরই পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের দাওয়াতও খাচ্ছি দলবল মিলে। কেউ বিয়ের পর পড়া চালাচ্ছে, কেউ আর পড়ছে না। এসব সহনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো ততদিনে। কিন্তু জেরিনের মতো কেউ লাপাত্তা হয়ে যায়নি। ফোন দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। আমার বাড়তি আগ্রহ দেখে সবাই বলতে লাগলো জেরিন তোরে ছ্যাকা দিয়া চইলা গেছে। এখন ছ্যাকা হোক আর বোকা হোক, ভেতরটা জায়ফলের মতো খটমট করতে লাগলো। ততদিনে এটুকু বুঝতাম জয়ত্রী আর জায়ফল হলো সুখ আর দুঃখের মতো একই গাছের দুই ফল। জয়ত্রী হলো ওপরের অংশটুকু যা সুখ আর ভেতরে খুটখুট করতে থাকা দুঃখের বীজটি হলো জায়ফল।

যাইহোক সেমিস্টার ফাইনালের শেষের দিকে চলে গিয়েছিলাম। তার মাঝেই নিজেরও বিয়ের কথা চলছে। সব নিয়ে জেরিন যেনো ভাবনা থেকে অনুপস্থিত। বিয়ের দিন যেদিন হলুদ মাখানো হবে আর কিছুক্ষণ পর, আমার খুব করে মনে হলো জেরিনের কথা। কী জানি কী? আগপাছ কিছু না ভেবেই ছুটলাম শান্তিনগর জেরিনের বাড়ি। যেয়ে জানতে পারলাম এক ভয়ংকর সত্য। প্রেম করেছিলো জেরিন হিন্দু বংশের এক ছেলের সাথে। বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেয়াতে পালিয়ে বিয়ে করেছিলো দুইজন।কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। এক বাসা ভাড়া করে সেই ছেলে তাকে ফেলে রেখেছিলো দিনের পর দিন। সামাজিক স্বীকৃতি দেয়া তো দুরস্ত, জড়িয়েছিল অন্য এক প্রেমে। আত্মহত্যার পথ সহজ মনে হয়েছিলো আমাদের সেই হাসিখুশি ছটফটে জেরিনের।

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে গেলাম, কেন জানি জেরিনের মায়ের কান্নাও খুব অসহ্য লাগছিলো। বেশিক্ষণ না থেকেই হেঁটে হেঁটে বাড়ি আসলাম। ভেতরে তোলপাড় আর মরা মাছের চোখ নিয়েই বসলাম বিয়ের পিঁড়িতে। অনেকেই আমার সেই উদাসীনতা দেখে ভেবেছিলো বিয়েতে বুঝি কনের সম্মতি নেই। কথায় আছে না ডেরা সাপে না কাটলেও অভিশাপে কাটে শত। আমার দশা তেমন। ডেরা সাপ মানে প্রেমে ছ্যাকা খাইনি তো কী হয়েছে? মানুষের মুখে মুখে রটে গেলো আমার বুঝি আগে প্রেম ছিলো।ভাগ্যিস বর বুঝদার ছিলো। তাই বিয়েটা খোঁটা ছাড়াই সম্পন্ন হলো। কিন্তু হলে কী হবে, ওই যে জায়ফল খুটখুট করছে মনের ভেতর তার কী হবে?

লিখতে বসলাম আমার জীবনের প্রথম উপন্যাস। ‘কাঁটাতারের পরিযান’। জেরিনকে মাথায় রেখে লিখলেও পালটে দিলাম নাম, ধর্ম। প্রধান চরিত্রের নাম রাখলাম সেঁজুতি। সেঁজুতিকে যথারীতি বাবা ত্যাজ্য করে ঘর থেকে বের করে দেয় মুসলমান তনয়-এর সাথে প্রেম করার পাপে। তনয়ের নামে ছাদনা তলায় সিঁথিতে সিঁদুর পরে সেঁজুতি ঠিকই কিন্তু শেষ পরিনতি হিসেবে সংসার করা হয়ে ওঠে না দুজনের। তবে জেরিনের যে অপমৃত্যু তার প্রতিবাদে আমার গল্পের নায়িকার আত্মহত্যা আমি লিখিনি।

আমি লিখেছি সেঁজুতির ঘুরে দাঁড়ানোর কথা যা চাইলে মেধাবী জেরিনও করতে পারতো। আমি লিখেছি সেঁজুতির মায়ের চরিত্রে আরেকজন শক্তিশালী নারী আন্না বসুর কথা যে বাবা আর মেয়ের মাঝে সেতু হয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করেছে চৌকস বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।সেঁজুতির মনোবল আর আন্না বসুর বুদ্ধিমত্তা ও উদারতা সমাজে লিখে রাখতে চেয়েছি দৃষ্টান্ত হিসেবে। যদি কোন ঘরের মা, সন্তানের বিপদে দশভুজা দুর্গার মতো সব বিপদকে মোকাবিলা করে আর সমাজের মুখে চপেটাঘাত মারতে পারে তাহলে সমাজে কোন সন্তান আর মৃত্যু সহজ মনে করবে না বেঁচে থাকার চেয়ে।

সেঁজুতি আর আন্না বসু তাই শুধু আমার উপন্যাসের চরিত্রই না বরং তারা সব প্রশ্নের জবাব যা যুগ যুগ ধরে নারীদেরকে দুর্বল করে রেখেছে কখনো প্রেমের নামে, কখনও শরীরের নামে, আবার কখনও সমাজ সংসারের রাস্তায় রাস্তায়। হেরে যাওয়া মানুষের উঠে দাঁড়ানোর গল্প, সমাজকে নতুন করে সাজানোর দুই অনন্যসাধারণ চরিত্র সেঁজুতি আর আন্না বসু লিখে নিজের কাছেই মনে হয়েছে– এ যেনো আমি লিখিনি, কোন এক অদৃশ্য যেনো আমাকে দিয়ে লিখিয়েই নিয়েছে।

বিষয়:
পরবর্তী খবর

কবি হেলাল হাফিজ আর নেই

প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ আর নেই। শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া জানান, শুক্রবার শাহবাগের সুপার হোম হোস্টেল থেকে তাকে অজ্ঞান অবস্থান উদ্ধার করে পিজি হাসপাতালে (বিএসএমএমইইউ) নেয়া হলে সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

কবির ভাতিজি রিনি বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে পিজি হাসপাতাল থেকে কবি হেলাল হাফিজের মরদেহ গোসলের জন্য মোহাম্মদপুর তাকওয়া মসজিদে নেওয়া হয়েছে। পরে সেখান থেকে পুনরায় তার মরদেহ পিজি হাসপাতালে রাখা হয়েছে।

কবি হেলাল হাফিজের বড় ভাই দুলাল হাফিজ জানান, কবির প্রথম জানাজা শনিবার সকাল ১১টায় বাংলা একাডেমিতে এবং বাদ যোহর জাতীয় প্রেসক্লাবে দ্বিতীয় জানাজা শেষে নেত্রকোনায় নিয়ে যাওয়া হবে। পরে তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে।

হেলাল হাফিজকে কোথায় সমাহিত করা হবে এ বিষয়ে মৃত্যুর আগে কবি কিছু বলে গেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, মৃত্যুর পর কোথায় রাখা হবে তা কখনো তিনি বলতেন না। তার আসলে আর কখনো ঘরে ফেরাই হলো না।

সুপার হোম হোস্টেলের ম্যানেজার জায়েদ আল সাবিত বলেন, আমার সঙ্গে আজ সর্বশেষ দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে কথা হয়। বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। রক্তাক্ত অবস্থায় আনুমানিক ২টা ১০মিনিটের দিকে বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে তাকে পিজি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে পৌঁছানোর পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্ম গ্রহণ করেন বরেণ্য কবি হেলাল হাফিজ।

১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ দিয়েই মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন হেলাল হাফিজ। এ কাব্যগ্রন্থভুক্ত প্রতিটি কবিতার শেষে উল্লিখিত তারিখ থেকে জানা যায়, কবিতাগুলো লেখা হয়েছে ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে।

প্রথম কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে হেলাল হাফিজ পাঠক মনে যে নাড়া দিয়েছেন, তা এখনও ইতিহাস হয়ে আছে। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থটির এখন পর্যন্ত ৩৩ বা তারচেয়ে বেশি সংস্করণ হয়েছে। যা এর আগে বাংলাদেশের কোনো কবিতার বইয়ের বেলায় ঘটেনি। এই কবিতার বইয়ের পাঠকের সংখ্যা যে অগণিত, তা বলাই বাহুল্য।

‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থই হেলাল হাফিজকে দিয়েছে অসামান্য খ্যাতি। এরপর দীর্ঘদিন আর কোনো বই বের করেননি তিনি। ২০১২ সালে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার সঙ্গে কিছু কবিতা যুক্ত করে প্রকাশ করা হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় তৃতীয় কবিতার বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’।
কবিতার জন্য ২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান।

এত কম কবিতা লিখে এত খ্যাতি পাওয়ার নজির বাংলাদেশের সাহিত্যে নেই।

১৯৬৫ সালে হেলাল হাফিজ নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ওই বছরই কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক ‘পূর্বদেশে’ সাংবাদিকতা শুরু করেন।

১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সাহিত্য-সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক ‘দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য-সম্পাদক পদে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।

কবিতায় অসামান্য অবদানের স্মারক হিসেবে হেলাল হাফিজকে ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। এ ছাড়াও তিনি পেয়েছেন- যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেকদাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা।

কবি হেলাল হাফিজের লেখালেখির সূচনা ঘটে ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি তাকে কবিখ্যাতি এনে দেয়। সাংবাদিকতা করার দরুণ কবি ওই সময়ের উত্তাল পরিবেশের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পেরেছিলেন।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কবি হাসান হাফিজ ও সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া এক শোক বার্তায় সাংবাদিক ও কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ শোক বার্তায় মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রাত গভীর সমবেদনা জানান।

সাংবাদিক ও কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছে।

পরবর্তী খবর

মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস

রক্তের মূল্যে স্বাধীনতা

২.
মাজহারুল হক মন্টু। যশোরের ছাত্র রাজনীতির অঙ্গনে একটা পরিচিত নাম। স্নাতক শেষবর্ষের ছাত্র। স্কুলজীবন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ১৯৬৯ সালের স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে তার রয়েছে অনন্য সাধারণ ভূমিকা। তাছাড়াও ১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে সক্রিয় প্রচারণায় অংশগ্রহণ করে দলের ভেতরে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে তুলেছেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের পর ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আওয়ামী লীগের নানা টানাপোড়েন শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পূর্বে আহুত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর সারা বাংলাদেশের মতো যশোর শহরেও প্রবল গণআন্দোলন শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় যশোর শহরের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে এসে আন্দোলন শুরু করে। ৩ মার্চ ছাত্র-জনতার একটা মিছিল যশোর কালেক্টর ভবনে উড্ডীন পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা নামিয়ে একটা কালো পতাকা উত্তোলন করে যখন ফিরে আসছিল, তখন টিএন্ডটি ভবন থেকে পাকিস্তানি সেনারা গুলি বর্ষণ করলে চারুবালা নামে একজন গৃহবধূ নিহত হন। যার ফলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে থেকে বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে সারা বাংলাদেশের মতো যশোরেও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। তখন প্রতিদিনই শহরে চলতে থাকে প্রতিবাদ মিছিল, মিটিং।

২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে ছাত্রনেতা খান টিপু সুলতানের নেতৃত্বে যশোর শহরের নিয়াজ পার্কে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৫ মার্চের রাতের আঁধারে হানাদার খান সেনারা যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরে প্রবেশ করে রাস্তায় অবস্থানরত জনতার উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে অনেক সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। অন্যদিকে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই সারাদেশে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মাযহারুল হক মন্টু একজন ছাত্রনেতা হিসাবে যশোর শহরের আন্দোলনের প্রতিটা স্তরে যথাযথ ভূমিকা রাখার পাশাপশি শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু সাধারণ ৩০৩ রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করে আধৃুুনিক অস্ত্র সজ্জিত শত্রুসেনাদের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত হয়ে তার নেতৃত্বে একটা গেরিলা দল নিয়ে গত ৭ দিন আগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যশোর সদর থানার প্রত্যন্ত এলাকা কাশিমপুর গ্রামে সেল্টার গ্রহণ করেন। তিনি কলেজ পড়ুয়া একজন যুবক হলেও তাকে দেখে মনে হয় যেন একজন আর্মি অফিসার। কথাবার্তায় চালচলনে যেন আভিজাত্য ঝরে পড়ে। সামরিক বাহিনীতে সৈনিকদের যেমন কড়া আইন কানুনের মধ্যে থাকতে হয়, তেমনি তার অধীনের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের থাকতে হয় কঠোর আইন কানুনের মধ্যে। পান থেকে চুন খসলেই কারো রেহাই নেই। সেন্টি ডিউটি বা রেকি করা কোন কাজেই সামান্যতম অবহেলাও তার সহ্য হয় না।

সেই কড়া স্বভাবের মাজহারুল হক মন্টুকে আজ কিন্তু খুব প্রাণখোলা এবং খোশমেজাজে দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে অবশ্য একটা বড় কারণ আছে । তাহলো তার নেতৃত্বে আরও কয়েকটি গেরিলা দল মিলে আজ ভোর রাতে যশোর শহরের পূর্বের খাজুরা হাই স্কুল রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে বেশ কিছু রাজাকারকে হত্যা করে সফলতা দেখিয়েছে। অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের এই সফলতার পেছনে মোঃ ইসহাক নামের একজন সামরিক প্রশিক্ষপ্রাপ্ত মুজাহিদ সদস্যের অবদান সবচেয়ে বেশি। মুক্তিযোদ্ধা দলের সদস্য না হয়েও সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং খাজুরা রাজাকার ক্যাম্পের পাশের লেবুতলার গ্রামে বাড়ি হওয়ায় ক্যাম্পটির সেন্টি পোস্ট ও অন্যান্য অবস্থান সম্বন্ধে তার স্পষ্ট ধারণা ছিল। সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হওয়ায় যশোর অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে ইসহাক ইপিআর বাহিনীর সাথে প্রথম পর্যায়ের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। সেই যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর প্রতিরোধ যোদ্ধারা ভারতে চলে গেলেও নতুন বিবাহিত স্ত্রী এবং পরিবারের অসুবিধার কথা ভেবে সে ভারতে যাওয়া থেকে বিরত ছিল। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করার পর সে আর ঘরে বসে থাকতে পারেনি। মাজহারুল হক মন্টুর গেরিলা দলটি কাশিমপুর গ্রামে সেল্টার গ্রহণ করার পর থেকেই সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে মন্টু সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে। তারর যোগ্যতা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার প্রচণ্ড আগ্রহ দেখে মন্টু সাহেব তাকে নিজ দলে অন্তভূক্ত করে নেন।

কাশিমপুর গ্রামে সেল্টার গ্রহণ করার পর থেকেই খাজুরা হাই স্কুল রাজাকার ক্যাম্পের নানা অপকর্মের কথা মন্টু সাহেবের কানে আসছিল। মাত্র ১০/১২ দিনের মধ্যে ২টি বাড়ি লুট এবং বেশ কয়েকজন নারীর সম্ভ্রমহানীর সাথে তাদের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় অন্যান্য গেরিলা কমান্ডারের সাথে আলোচনা করে মন্টু সাহেব খাজুরা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর একই এলাকায় বাড়ি, অবাধ যাতায়াতের সুযোগ এবং সামরিক বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হওয়ায় ক্যাম্পটি সরেজমিনে রেকি করে একটা খসড়া আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়ণের জন্য তিনি ইসহাককে দায়িত্ব প্রদান করেন। সেও সুযোগটি মনেপ্রাণে গ্রহণ করে। তারপর অবাধ যাতায়াতের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটা নিখুঁত আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সে তা মন্টু সাহেবের নিকট জমা দেয়। সেই আক্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে ৫ জন গেরিলা কমান্ডার আলোচনা করে সামান্য কিছু কাটছাট করে চুড়ান্ত করা হয়। তারপর মাযহারুল হক মন্টুর নেত্বত্বে ৫টা গেরিলা দলের ৫৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আজ ভোর তারা রাতে খাজুরা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে শতভাগ সফলতা লাভ করে। শুধু যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়নে সহযোগিতা নয়, ইসহাক অস্ত্র হাতে সরাসরি গুলিতে শত্রুর ২ জন সেন্টিকে হত্যা করে যুদ্ধ জয়ে অনেক ভূমিকা রেখেছে। তাইতো আজ সারাদিন ক্যাম্পে একটা আনন্দের আমেজ লেগে আছে। সাথে সাথে চলছে ইসহাক বন্দনা।

চলবে…

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত