বসন্ত শব্দটি শুনলেই একরাশ সজীবতা সঞ্চার হয় প্রাণে। শীতের রুক্ষতাকে পেছনে ফেলে প্রকৃতিকে আবার নতুন রূপে সাজিয়ে তোলার আগমনী বার্তা নিয়ে বসন্তের আগমন। বসন্তের অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বসন্তটা যেনো একটু বেশিই সুন্দর।
কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। বসন্তের আগমন চারদিকে বাঙালিদের হৃদয়ে ব্যাকুলতা জাগিয়ে তুলছে। এই ব্যাকুলতা জেগে উঠেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনেও।বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মেতে উঠছে বসন্ত উৎসব উদযাপনে। বসন্ত উদযাপনের জন্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লাল, হলুদ, সবুজ, বাসন্তী রঙের শাড়ি পাজ্ঞাবি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনের মাধ্যমে বসন্তের আগমনী বার্তা দিয়ে মুখরিত করে তোলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা আলপনা এঁকে, ফুল ও রঙিন কাগজ দিয়ে সুসজ্জিত করে তুলেছে ক্যাম্পাস।
শীতের রুক্ষতা ও নিষ্প্রাণ প্রকৃতিকে ছাপিয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গাছের ফুলের সুবাস। প্রবীণ থেকে নবীন শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত ক্যাম্পাসের বিভিন্ন চত্বর, মুক্তমঞ্চসহ বিভিন্ন স্থান। এছাড়া সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর উদ্যেগে এবং বিভিন্ন বিভাগ থেকে গান বাজনা, নৃত্য ও আবৃত্তিসহ আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শিক্ষার্থীদের মধ্যে বয়ে এনেছে আনন্দ ও উৎসব মুখর পরিবেশ। বসন্ত উদযাপন উপলক্ষে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাহারি রঙের শাড়ি পাঞ্জাবি এবং মেয়েরা খোপায় গাঁদা ফুলের মালা পরে বসন্তের রঙে রাঙিয়ে নেয় নিজেদের।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার নাম ছিলো ‘বাসন্তিক’। সন্ধ্যায় সকলকে বসন্তের শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিক্ষার্থীরা নাচে গানে বরণ করে নেয় ঋতুরাজ বসন্তকে।
প্রকৃতি শীতের আগমনি বার্তা জানাতে শুরু করেছে। গ্রাম অঞ্চলে সন্ধ্যা হলেই শীত অনুভূত হতে থাকে এবং সকালে ঘন কুয়াশা ও শিশির দেখা দেয়। শীত শুরু হলেই গ্রামীণ জনপদের মাঠ, ময়দান, রাস্তাঘাটে গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
গাছিরা খেজুর গাছকে সুন্দরভাবে পরিষ্কার করে গাছের বুক চিরে রস বের করেন। এই সুস্বাদু রসের চাহিদা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক। শীত যত বাড়ে, খেজুর রসের চাহিদা ততই বৃদ্ধি পায়। বহু বছর ধরে গ্রামবাংলায় খেজুর রস দিয়ে নানা ধরনের পিঠা ও পায়েস তৈরি হয়।
রবিবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে পোরশা সুতর ইল মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে আগুনে জাল দিয়ে পাটালি ও লালির গুড় তৈরি করছেন। শীত মৌসুমের এই সময়ে গাছিদের যেন দম ফেলার সময় নেই।
পোরশা অঞ্চলে খেজুর রসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এখানে এক কেজি রস বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকায় এবং খেজুরের লালি ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
খেজুর রস সংগ্রহের জন্য গাছিরা খেজুর গাছের বুক চিরে সাদা অংশ বের করেন। একটি বাঁশের জীবা তৈরি করে গাছে লাগিয়ে মাটির কলসি বেঁধে সকাল ও সন্ধ্যায় রস সংগ্রহ করেন।
এদিকে, বর্তমানে খেজুর রস থেকে নিপা ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যা মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তবে, এ বিষয়ে ডাক্তার মোহাম্মদ জুবায়ের হোসেন বলেছেন, ‘৭০-৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় খেজুর রস ফুটিয়ে খেলে নিপা ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়।’ তিনি সবাইকে খেজুর রস ফুটিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
গাছিরা জানান, বর্তমানে অনেকক্ষেত্রে অপ্রয়োজনেও খেজুর গাছ কেটে ফেলছেন। এতে একসময় খেজুর গাছের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। তাই আমাদের বেশি বেশি খেজুর গাছ রোপণ করতে হবে, যাতে আমরা এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারি।
ছোট মাছের শুঁটকি ও কচুর ডাটা দিয়ে তৈরি করা এক প্রকারের খাবারের নাম ‘সিদল’। ঠাকুরগাঁওয়ে শিবগঞ্জ গ্রামবাংলার মুখরোচক খাবার হিসেবে এর কদর রয়েছে যথেষ্ট। সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্য ও স্বাদের কারণে এ অঞ্চলের মানুষের এটি অতিপ্রিয় একটি খাবার।
পারিবারিক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে পাঠানো সওদা হিসেবে কিংবা নিজ বাড়িতে আপ্যায়নের ক্ষেত্রে একসময় সিদল ছিল অন্যতম একটি উপকরণ। শুধু তা-ই নয়, হাটে-বাজারে বিক্রিও হতো গ্রামীণ পরিবারের নারীদের হাতের তৈরি এই মুখরোচক খাবার।
দিন বদলের ধারায় আর দেশীয় ছোট মাছের বিলুপ্তিতে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবারটি। এখন আর চোখে পড়ে না সিদল তৈরি করতে বাড়ির নারীদের কর্মব্যস্ততা। হাটে-বাজারে বিক্রির ধুম নেই। তবে সচরাচর না হলেও মাঝেমধ্যে দেখা মেলে। শখের বশে অনেকেই ঐতিহ্যবাহী খাবারটি এখনো তৈরি করেন। সিদল মূলত তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছ, যেমন- মলা, ডারকা বা পুঁটিসহ বিভিন্ন ছোট জাতের মাছ দিয়ে।
প্রথমে মাছগুলো ভালো করে ধুয়ে কড়া রোদে ৫-৬ দিন শুকিয়ে নিতে হয়। মচমচে হলে মাছের শুঁটকিগুলো শিল-পাটায় গুঁড়া করে নিতে হয়। এরপর সাদা মানা,ও কালো কচুর শুধু ডাঁটা ধুয়ে নিয়ে কাঁচা অবস্থায়ই বাটতে হয়। কচুবাটার সঙ্গে মলা, ডারকা বা পুঁটি মাছের আধভাঙা গুঁড়া, প্রয়োজনমতো শুকনা মরিচ, লবণ, রসুন, আদা বাটা সবকিছুর সঙ্গে মেশাতে হয়। সব মেশানো হয়ে গেলে একদিন পর মণ্ডগুলো হলুদ ও সরিষার তেল দিয়ে মেখে হাত দিয়ে গোল বা চ্যাপটা করে ৫-৬ দিন রোদে শুকাতে হয়। ডালা বা কুলায় ঢেকে (যাতে পাখি খেতে না পারে) শুকিয়ে একটু শক্ত হলে তৈরি হয় সিদল।
পরে শুকনো পাতিলে সংরক্ষণ করতে হয়। পাতিলে কিছু ছাই দিয়ে রাখলে বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট পোকার আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। শুকনো সিদল প্লাস্টিকের কাগজে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের বক্সে রেফ্রিজারেটরে রাখলে ৩ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। এক্ষেত্রে মাঝেমাঝে রোদে শুকানোর প্রয়োজন রয়েছে।
রান্না করার সময় সিদল থেকে ছাই ফু দিয়ে তুলে পরিষ্কার করার পর ভালো করে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়।
বিভিন্নভাবে সিদল রান্না করা যায়।
কাতলা বা বোয়াল মাছের সাথে সিদল মিশিয়ে একটু বেশি ঝাল দিয়ে রান্না করা হয়। শাক দিয়ে সিদল রান্নার প্রচলন সুপরিচিত হলেও জনপ্রিয় রান্নার পদ্ধতি হচ্ছে সিদল ভর্তা। এক্ষেত্রে ভাত নামানোর ৫ মিনিট আগে সিদল ভাতে দিয়ে সেদ্ধ করে নিতে হয়। পরবর্তীতে সেটি হালকা তেলে ভেজে ভাজা মরিচ, পিঁয়াজ, রসুন, লবণ, সরিষার তেল দিয়ে ভালো করে হাত দিয়ে বা পাটায় পিষে ভর্তা করতে হয়।
কালের বিবর্তনে মাছের সংকট এবং নানা ব্যস্ততার মধ্যে সিদল’ হারিয়ে যেতে বসেছে।